পুরুষ চিৎকার করে ওঠেন, ‘শোন শোন, স্ত্রী স্বামীর কাছে বেতন চায়!’

শেখ তাসলিমা মুন:

বললে, পুরুষ চিৎকার করে ওঠেন, ‘শোন শোন, স্ত্রী স্বামীর কাছে বেতন চায়!’ অনেক গর্দভ নারী গলা মেলান, ‘এতো নারীরই অমর্যাদা!’

গৃহশ্রম দিয়ে শুরু করা যাক। একটি হাউজহোল্ড মোটামুটি কত ঘণ্টার কাজ, সেটি কি আজও হিসেবে আনা হয়েছে? ধরা যাক, স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করেন। ৮ প্লাস ৮ = ১৬ ঘণ্টা বাইরে কাজ। ঘরে এঁদের ধরে নিলাম আরও ৮ ঘণ্টার কাজ। তাহলে এই আট ঘণ্টা কাজের শ্রমমূল্য নির্ধারণ করা কেন দরকারি নয়? ঐ ১৬ ঘণ্টার শ্রম মূল্য তারা ঘরে আনছেন কাজ করেই। এই আট ঘণ্টার একটি শ্রমমূল্য অবশ্যই আছে। শুধু সেটি হিসেব করলেই বিষয়টি অনেকটা বোধে চলে আসে।

তাদের একজন গৃহকর্মে সহকারি নিয়োগ দিতে হচ্ছে। তাঁদের ১৬ ঘণ্টার বেতন তোলার জন্য আট ঘণ্টার একটি হিসেব জরুরি হয়ে পড়ছে। এখন ঐ ১৬ ঘণ্টার পারিশ্রমিকে যদি একজন গৃহকর্মে সহকারি নিয়োগ সম্ভব না হয়, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ঐ আট ঘণ্টা সময় চার ঘন্টা করে ভাগ করে নিতে হচ্ছে।

এটা যদি একটি সিস্টেমে পর্যবসিত করা যায় তাহলে জেন্ডার রোল ঘরেই ব্যালান্সড হয়ে যায়। সকালে নিজেদের নাশতা নিজেরা বানিয়ে খাওয়ার জন্য উভয়কে উঠতে হচ্ছে ভোরে। বিকেলে কাজ শেষে বাড়িতে না ফিরে ক্লাবে রাত ১২ টা পর্যন্ত আড্ডা দেওয়ার সময় হচ্ছে না। অফিস শেষে বাজার করে বাসায় ফিরতে হচ্ছে। ডিনার রান্না, লাঞ্চ বক্স রেডি করে ঘুমুতে যেতে হচ্ছে।

কিন্তু আসল ব্যাপারটা হচ্ছে আলাদা। দেখা যাচ্ছে, পরিবারের নারীজন অফিস থেকে ফেরার পথে কাঁচা বাজারে ঢুকছেন। বাড়িতে ঢুকেই রান্না ঘর। রাত দশটা পর্যন্ত রান্না ঘর। আর ‘তিনি’? তিনি তখনও বাড়ি ফেরেননি। স্ত্রী অফিসে আট ঘণ্টা কামলা দিয়ে আর আট ঘণ্টা নিয়ে বসেছেন। বাসায়ও কাজ করছেন। বাসায় কখন চাল শেষ, কখন তেল শেষ, সাবান শেষ, মোজা কয় জোড়া পরিষ্কার আছে ‘তেনার’, আন্ডার গারমেন্টস সাফ আছে কিনা এসব খবর তেনার নাই, রাখতে হচ্ছে নারীপিপটির এবং এ কাজগুলো আদৌ কাজের আওতায় কীনা, সেটি ‘তিনি’সহ কারোরই মাথায় ঢুকছে না। এর যে শ্রমমূল্য আছে সেটিও গণনায় আসছে না। শুনলেও চক্ষু কপালে উঠছে। তাঁদের কাছে গৃহকর্ম একটি ম্যাজিশিয়ানের দ্বারা সম্পন্ন হয়। ঘর ঝকঝক ম্যাজিকে হয়ে যায়। বাথরুমে বসে হাতের কাছে টয়লেট পেপার, বালতিতে পানি মগ অটো চলে আসে। ঘুম চোখে টেবিলে ডিম পোঁচ কীভাবে আসে তারা তা জানেন না। অটো এসে যায়। কিংবা একটু শরৎ বাবুয়ী ভাষায়, ‘মা অন্নপূর্ণা’ যোগান!

এখন ধরা যাক, এক পরিবারে কেবল একজন ইনকাম করেন। অন্যজন বাড়িতে থাকেন। বাড়ির কাজ ধরে নিলাম স্টিল ৮ ঘন্টাই। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, একজন বাইরে ৮ ঘণ্টার শ্রম দিয়ে ঘরে আসছেন। অন্যজন বাড়ির কাজ করছেন ৮ ঘণ্টা ধরে। তাঁদের টোটাল শ্রম ১৬ ঘণ্টা। এখানে ১৬ ঘণ্টার শ্রমমূল্য গণনায় আনতে হবে।

কিন্তু কাজগুলো যেহেতু হচ্ছে বিনামূল্যে, সেহেতু এ শ্রমমূল্য মার্কেটে আসছে না।
এ পরিশ্রমের জন্য তাঁকে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া লাগছে না। অর্থাৎ এ পরিবারের ৮ ঘণ্টার পরিশ্রমের শ্রমমূল্যের কমপক্ষে চার ঘণ্টা মূল্য বেঁচে যাচ্ছে কেবল তার স্ত্রী কাজ করার জন্য। এখানে যদি ধরে নেই স্ত্রীর চার ঘণ্টা এবং স্বামীর চার ঘণ্টা হাউজহোল্ডে, তাহলে স্ত্রী সে কাজটি একা করছেন।

আর একটি দিক, এই শ্রমিক তার কাজে খুচরো সাহায্যের জন্য নিয়োগ দিলেন আরেকজন শ্রমিকের। তাঁকে নুন্যতম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করিয়ে তার শ্রমকে র‌্যাশনাইলজড করার অভিপ্রায়ে দুটো বঞ্চনা মুখ্য হয়ে উঠেছে বিনা বেতনের শ্রমিকের সহকারিরও। তবু একটি ‘এক্সপ্লইয়টেশন মূল্য’ নির্ধারিত হয়, কিন্তু মূল হাউজহোল্ডের শ্রমমূল্য নির্ধারণ হয় না, সে শ্রমিকেরও নয়।

দ্বিতীয়ত, শ্রম ও শ্রমিকের বহুমাত্রিক এক্সপ্লয়টেশন কেবল পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে শক্তিশালী করছে। শ্রমের মর্যাদা বোধের ধারে কাছেও আসছে না।

শেয়ার করুন: