মেট্রোয় আলিঙ্গন কেন? হিড় হিড় করে টেনে নামিয়ে গণপ্রহার যুগলকে

উজ্জ্বল চক্রবর্তী (আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে):

চাঁদনি চক থেকে মেট্রোয় উঠেছিলাম। রোজ যেমন উঠি। সঙ্গে আমার এক সহকর্মীও। স্টেশন ছাড়তেই একটা উত্তেজিত কথোপকথন কানে এল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তার থেকে কয়েকটা গেট দূরেই হইচইটা হচ্ছিল। প্রথমে বুঝতে পারিনি, খুব গুরুত্বও দিইনি। কারণ পথে-ঘাটে ও রকম হইচই হয়েই থাকে। কিন্তু ওই গোলমালটা যে এমন দুঃস্বপ্নের চেহারা নেবে কিছুক্ষণের মধ্যেই, তা একেবারেই বুঝতে পারিনি।

এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে যে শহরটাকে চিনি, সেই কলকাতা তলে তলে এত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে! এত অসংবেদনশীল, এত নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে শহরটা! এখনও ভাবতে পারছি না। আক্ষরিক অর্থেই দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে।

বেশ ভিড় ছিল মেট্রোয়। ঠেলেঠুলেই ঢুকতে হল ভিতরে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোলমালটা শুরু হয়েছিল। প্রথমে সে দিকে মন দিতে পারিনি। কারণ যে সহকর্মীর সঙ্গে ফিরছিলাম, তাঁর পোস্টিং পটনায়। কয়েক দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন। অনেক দিন পরে একসঙ্গে ফিরছিলাম। তাই খোশগল্পে মশগুল হয়ে ছিলাম। যদি জানতাম, এমন অসভ্যতা এবং বর্বরতার সলতে পাকানো হচ্ছে, তা হলে সম্ভবত সহকর্মীর সঙ্গে খোশগল্পে ও ভাবে মজে থাকতে পারতাম না।

সহকর্মী নেমে গেলেন শোভাবাজারে। ততক্ষণে বেশ বেড়ে উঠেছে গোলমাল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কৌতূহলের বশে। বুঝলাম, ভিড়ের মাঝে আলিঙ্গনাবদ্ধ যুগলকে দেখে কয়েকজন বড্ড উচাটনের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন। কেন মেট্রোয় পরস্পরকে আলিঙ্গন করবেন তাঁরা? কেন পার্ক স্ট্রিটের কোনও বারে যাবেন না? এমন নানা অবান্তর প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন?

যিনি মূলত প্রশ্নগুলো তুলছিলেন এবং হইচইটা করছিলেন, তিনি বয়সে বেশ প্রবীণ। মাথা প্রায় পুরোটাই সাদা।

সুদর্শন, সুঠাম যুবক কিন্তু নির্ভীক ভঙ্গিতেই উত্তর দিচ্ছিলেন। তাঁদের আলিঙ্গনে অন্য কেউ কী ধরনের সমস্যার পড়তে পারেন? বেশ ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন যুবক। উত্তর খুঁজে না পেয়ে আরও তেতে গেলেন বৃদ্ধ। আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলেন।

যুগল কিন্তু তাতেও মেজাজ হারায়নি। তরুণী প্রশ্ন করলেন, ‘‘ভিড়ের মধ্যে যদি আমরা নিজেরা নিজেদের সিকিওরিটির ব্যবস্থা করে নিই, তা হলে আপনার সমস্যা কোথায়?’’ উত্তর নেই বৃদ্ধের কাছে এ বারও। অতএব রেগে আরও কাঁই। আরও চিৎকার শুরু। দু’জনকেই গালিগালাজ এবং উচিত শিক্ষা দেওয়ার শাসানি।

আলিঙ্গনাবদ্ধ যুবককে কটাক্ষে বিঁধতে গিয়ে বৃদ্ধ এ বার বললেন, ‘‘নিজেকে সলমন খান মনে করছে।’’ এই মন্তব্যে বেশ কৌতূক বোধ করলেন যুবক। আশেপাশে উপস্থিত সব সহযাত্রীর উদ্দেশে যুবক বললেন, ‘‘আপনারা সবাই শুনলেন তো? উনি কিন্তু আমাকে সলমন খান বললেন। আমি এটা কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই নিচ্ছি।’’

সুদর্শন তরুণ বুঝতে পারেননি, তাঁর আশেপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মনটা তাঁর মতো তরতাজা নয়। তিনি বুঝতে পারেননি, ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় খোলা হাওয়া খেলছে না, বরং একটা বদ্ধ-দূষিত বাষ্প ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই বিপর্যয়টা ঘনিয়ে উঠল দ্রুত।

এত ক্ষণ এক জনই চিৎকারটা করছিলেন। আলিঙ্গনাবদ্ধ যুবক তাঁর দিকে কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন দেখে এ বার আরও অনেকেরই যেন ‘বিবেক’ জাগ্রত হল। ‘‘এ ভাই, বড্ড বেশি কথা বলছ কিন্তু।’’ গলা চড়ল একে একে। ধমক-ধামক আর নয়, সরাসরি হুমকি শুরু হয়ে গেল— ‘‘দমদমে নাম, তোদের দেখছি।”

তখনও বুঝিনি, এত দূর গড়িয়ে যাবে ঘটনাটা। হুমকি শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু দমদমে পৌঁছে সত্যিই ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে দেওয়া হবে, কর্মক্লান্ত একটা দিনের শেষে ঘর-সংসার-পরিবারের কাছে ফেরার তাড়না ভুলে এক ঝাঁক লোক আলিঙ্গনের শালীনতা-অশালীনতার বিচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, এমনটা আঁচ করতে পারিনি। তাই বিপদটা ঘটে যাওয়ার আগে হস্তক্ষেপ করতে পারিনি।

দমদমে মেট্রোর দরজা খুলতেই ওই যুগলকে হিড় হিড় করে টেনে প্ল্যাটফর্মে নামালেন কয়েক জন। তার পর শুরু হল গণপ্রহার। সিড়ির রেলিঙে ঠেসে ধরে শুরু হল বেদম মার। সঙ্গীকে বাঁচাতে তখন অসহায়, উদভ্রান্ত তরুণী। কিল-চড়-ঘুসি-লাথির মাঝে ঢুকে পড়ে সামনে থেকে জাপটে ধরলেন যুবককে, আড়াল করার চেষ্টা করলেন। তাতেও থামল না অতি-উৎসাহী ভিড়। তরুণীর পিঠের উরেই পড়তে থাকল কিল-চড়। ফাঁকফোকর দিয়ে মার চলল যুবকের উপরেও। আমি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি।

যাঁরা এই গণপ্রহারে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই কিন্তু মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ় বা প্রবীণ। অনেক বেশি সংযত, পরিশীলিত আচরণ প্রত্যাশিত যাঁদের থেকে, তাঁদের আচরণই সবচেয়ে উশৃঙ্খল হয়ে উঠল।

ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এলেন কয়েকজন যুবক এবং মহিলা। উত্তপ্ত ভিড়টার মাঝে ঢুকে পড়ে আটকে দিলেন মারধর। তার পর ভিড়ের মাঝখান থেকে উদ্ধার করে সিঁড়ির নীচের দিকে কিছুটা এগিয়ে দিলেন তরুণ-তরুণীকে।

অকারণে মারের মুখে পড়েছিলেন যুগল, তাঁদের রক্ষা করতে কয়েকজন এগিয়েও গেলেন। কিন্তু গোটা ঘটনাটা আমার বহু দিনের পরিচিত শহরটাকে যেন কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দিল। ২০১৮ সালের কলকাতায় এই রকম একটা ঘটনার সম্মুখীন হব! ভাবতেই পারছি না। আমি আটকাতে পারিনি অঘটনটা। ততেই সাংঘাতিক মানসিক কষ্ট বোধ করছি। আক্রান্ত যুগলের মানসিক অবস্থাটা তা হলে ঠিক কী রকম এখন? আমরা কি আদৌ ভবতে পারছি?

সিনেমার পর্দায় আলিঙ্গন বা চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি আমরা। ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ নামের একটা হিন্দি ছবির কথা লহমায় মনে পড়ছে। বিদেশের ট্রেন। ভারতীয় যুগল। টিকিট নেই। টিকিট পরীক্ষককে এড়াতে হিরো-হিরোইন ট্রেনের কামরায় গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। বিরক্ত করলেন না পরীক্ষক। টিকিট না দেখেই চলে গেলেন। আর টিকিট পরীক্ষকের সেই প্রস্থান দেখে হাততালিতে ফেটে পড়ল সিনেমা হল।

বাস্তবে মেনে নিতে পারলাম না একই ধাঁচের একটা দৃশ্য। মেট্রোর কামরায় প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতী পরস্পরকে আলিঙ্গন করায় তাঁদের ট্রেন থেকে হিড়ি হিড় করে টেনে নামিয়ে উন্মত্তের মতো মারধর করলাম আমরা।

প্রায় দু’দশকের আলাপ কলকাতা শহরের সঙ্গে। ভেবেছিলাম শহরটার নাড়ির স্পন্দন আমি চিনে গিয়েছি। কিন্তু কলকাতা মেট্রোয় একটা ১৫ মিনিটের যাত্রা, সে ভুল ভেঙে দিল। এই শহরটা আমার কাছে একদমই অচেনা। হয় আমি কোনও দিন চিনতেই পারিনি এই শহরকে। নয়তো শহরটা আমাদের অনেকের অগোচরেই ভীষণ রকম বদলে ফেলেছে নিজেকে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.