মাটির মূর্তিতেও যার কাম জাগে, এটা তারই সমস্যা

পুলক ঘটক:

নারীর স্তন প্রদর্শন কি অশ্লীলতা? না, সব সময় নয়। স্তন প্রদর্শন কখনো অশ্লীল, কখনো বা স্বর্গীয় সুন্দর। মা শিশুকে স্তন্য পান করাচ্ছেন -এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য জগতে আর কী হতে পারে? ভাস্কর্যে বা শিল্পে উপস্থাপিত এমন দৃশ্য একাধারে নয়নাভিরাম, হৃদয়াভিরাম ও পবিত্র। সে দৃশ্য দেখেও কেউ কেউ কামোদ্দিপ্ত হতে পারে। কামরোগীদের ভয়ে শিল্পীরা কি সৌন্দর্য সৃজনে ক্ষান্ত হবেন? “অমৃতমুরতিমতী বাণী” মূর্তি দেখে কেউ যদি কামার্ত হয়, তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে?

সরস্বতী প্রতিমা দেখে একজন আনিস আলমগীর কামোন্মত্ত হয়েছেন! তাতে আপনার, আমার কিংবা সমাজের কী সর্বনাশ হয়েছে? হ্যাঁ, আমি আমার হিন্দু ভাই, বোন, বন্ধুদের উদ্দেশ্য করেই বলছি। গত দুই দিনে যারা বারবার আমার ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে বলছি। আনিস আলমগীরের যৌন অনুভূতি দেখে নিজেদের ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র প্রকাশ ঘটাবেন না। কেউ কেউ আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করার কথা বলেছেন। আমি তাদের সরাসরি নিষেধ করেছি, করছি।

কয়েক হাজার বছরের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বর্তমানের বাঙালি হিন্দু সমাজ এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাক তা আমি চাই না। সমালোচনার প্রতি সহনশীলতা সনাতন হিন্দু সমাজের ঐতিহ্য। এখানে মুক্তমতের সর্বব্যাপী অবস্থান। সনাতন ধর্ম বিধানের বেড়া বেঁধে দিলে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে হাজার বছর যাবত শ্লীল/অশ্লীল নানাবিধ সাহিত্য রচনা শুরুতেই বন্ধ হয়ে যেত। কেউ ভগবানের বুকে লাথি মারতে চাইলেও হিন্দুরা চাপাতিতে শান দিতে পারে না। বুঝতে হবে, ছয় হাজার বছর আগের হিন্দু তার ভগবানের বুকে সত্যিই লাথি মেরেছিল। ভগবানের বুকে লাথি মারা সেই হিন্দুর বিচারের দাবিতে সেদিন কেউ কলম ধরেনি, মিছিল করেনি, চাপাতি হাতে ধাওয়াও করেনি। বরং লাথি মারার সে কাহিনী হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মর্যাদার সাথে স্থান পেয়েছে। ভগবানের বুকে ভক্তের পদচিহ্ন স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে। “বিষ্ণু বুকে চরণ চিহ্ন, ললাট লেখা কে খণ্ডায়?” আজও বিষ্ণুপুজার সময় ভৃগু পদচিহ্নে ফুল দিতে হয়। প্রতিদিন মানবের স্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেন পুজারী। নিজ বক্ষে মানুষের পদচিহ্ন ধারণ করে ভগবানও মহীয়ান হন! (কাহিনীর আদ্যোপান্ত জানতে মহাভারত ও পূরাণ পড়ার সুপারিশ রইল।)

“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!”

কেমন ছিল হাজার বছর আগের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি? আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ ভগবানের বুকে লাথি মারার কথা ভাবতে পারলো! এমনকি সেই কথা ধর্ম সাহিত্যে স্থান পেল; ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে গেল! বিংশ শতাব্দীতে একই কথা কাজী নজরুল ইসলাম তার সাহিত্যে এনে সমালোচিত হলেন! নজরুল যদি আজকের দিনের মানুষ হতেন, তাহলে লেখার অপরাধে তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হতো কিংবা জঙ্গিরা তাকে মেরেই ফেলতো।

পুরাণ যুগ থেকে ব্রিটিশ আমল এবং সেখান থেকে বর্তমান আমল – পরিবর্তনটা খেয়াল করুন। শিক্ষার হার বেড়েছে, সহনশীলতা কমেছে এবং মুক্ত চর্চার ভূবনে অনেক বেড়া গজিয়েছে। বেড়া ডিঙিয়ে ওপারের দিকে তাকাতে সাহস আছে ক’জনার?

হিন্দু বন্ধুরা, আপনারা অন্তত বেড়াগুলো ডিঙান। কারণ আপনার ধর্ম বেড়া মানে না। আপনার ধর্ম বহুত্ববাদী। এখানে আস্তিক্য আছে, নাস্তিক্য আছে। একেশ্বরবাদ আছে, বহুশ্বরবাদ আছে। সনাতন ধর্মের এই বৈচিত্র্যটা বুঝতে হবে। এই ধর্মে ঈশ্বর এক ও বহু। ঈশ্বর নিরাকার এবং সাকার দুটোই। এখানে চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং নৃত্য উপাসনার অঙ্গ। এখানে মাতৃ পূজা আছে। কাম ও রতির পূজাও আছে। এসব নিয়ে ধর্মানুভূতিতে কাতর হওয়ার সমাজ কাঠামো নেই।

এই ধর্ম কারও মতবাদকে ফেলে দেয়নি; খুন করতে উদ্যত হয়নি। নইলে চার্বাক জড় দর্শনের মতো নীতিহীন ভোগবাদী (যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতাঃ। অর্থ্যাৎ যতো দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। ঋণ করেও ঘি খাও। আগুনে ছাই-হওয়া দেহের পুনরাগমন কোথায়?) নাস্তিক্য মতবাদের অবিকৃত অবস্থান সনাতন ধর্ম সাহিত্যে থাকতো না।

সনাতন ধর্মে সরস্বতী দেবী। এখানে তিনি মাতৃরূপা -এটা সত্য। তাই বলে কি কামরূপা নন? তিনি বাণীরূপা, জ্ঞানের মূর্ত প্রতিক। বায়ু বা জল ঘনিভূত হলে বরফের মূর্তি নেয়। বিশ্বের তাবত জ্ঞান ঘনিভূত হলে সেই মূর্তির নাম হয় সরস্বতী। এটা ভক্তের ভাব! সরস্বতী হচ্ছে অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত রূপ। কামরূপ তার একটি। কামশাস্ত্রেরও তিনিই আধার। হ্যাঁ, কামবিদ্যাও সরস্বতী’র বহুরূপের একটি। এক নারী কারও কাছে মাতৃরূপা, কারও কাছে রতিরূপা। সুতরাং কেউ কামদৃষ্টিতে তাকে দেখলে ধর্মমতে তাকে বাধা দিতে পারেন না। তবে ব্যক্তিটির দৃষ্টিভঙ্গি জেনে রাখতে পারেন, স্বরূপ চিনে রাখতে পারেন।

কামুক ব্যক্তি আপনার রচিত মাতৃ মূর্তিকে তার কামুক দৃষ্টিতে দেখলে আপনি কষ্ট পেতে পারেন, কিন্তু করার কিছু নেই। আপনার মা সম্পর্কে কেউ (পাবলিকলি) অশ্লীল ঈঙ্গিত বা কামুক মন্তব্য করলে আপনি ক্ষিপ্ত হতেই পারেন। কিন্তু যিনি অদেখা ঈশ্বর – যার সম্পর্কে একেক জনের বিশ্বাস একেক রকম, যাকে বিশ্বাসে জগদজননী বলে মনে করেন, রমণীর বিভিন্ন রূপে যিনি দৃশ্যমান -তার সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিদের মন্তব্যকে সবসময় ক্ষমার চোখেই দেখতে হবে। আপত্তিকর লেখা বা দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করতে পারেন — লেখায় এবং কথায় জবাব দিতে পারেন – এর বেশি নয়।

ভাই উত্তেজিত হবেন না। আনিস আলমগীরের লেখায় সরস্বতী আদৌ মাইন্ড করেননি। আনিস নিজেই নিজেকে এক্সপোজ করেছেন। তার প্রথম লেখাটি নোংরা ঈঙ্গিতপূর্ণ। দ্বিতীয় লেখায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আরো সুস্পষ্ট। সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অনুভূতিকে তিনি কেয়ার করেননি। সরস্বতী পুজার দিনেই এরকম লেখা পোস্ট করা হয়তোবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। উপাসক হিন্দুরা এতে আঘাত পেলেও কোনো উদ্দেশ্যের ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করবো।

“বাঁশী বাজে একই তানে, যার যেমন কান তেমনি শোনে।”

‘কুন্দ-বরণ-সুন্দর-হাসি, বীণা হাতে বীণাপাণি’র প্রতিমা দেখে আনিস আলমগীর যৌনোদ্দিপ্ত হয়েছেন। আর কোথায় কী দেখে তিনি উদ্দিপ্ত হোন, তা তিনিই জানেন। কিছুদিন আগে এক মনোবিদের লেখায় পড়েছিলাম, নারীর মলমূত্র দেখেও নাকি কিছু পুরুষের যৌন উদ্দিপন ঘটে। কারও ক্ষেত্রে রোগটা বেশি হতেই পারে। এ নিয়ে হিন্দুদের ক্ষিপ্ত হওয়ার দরকার কি? বরং সতর্ক হওয়া উচিৎ আনিসের নারী বন্ধুদের, মায়েদের এবং বোনদের। বিশেষ করে তার স্ত্রীর! এরকম মানুষের চোখ ও যৌনযন্ত্র থেকে নিরাপদ থাকা দরকার।

সরস্বতী মূর্তি দেখে যিনি উদ্দিপ্ত হন, সেক্স ডলে তার ব্যাপক উদ্দিপনার সম্ভাবনা। একান্ত জীবন কার কেমন তা কে বলতে পারে? তিনি বাসায় সরস্বতী মূর্তি বানিয়ে নিন, কিংবা সেক্স ডল দিয়ে নিত্য তৃপ্তি লাভ করুন, – হিন্দুরা এ নিয়ে ধর্মানুভূতিতে কাতর হবেন না। যৌন অনুভূতির মতো ঐ ধর্মানুভূতিটাও আনিস আলমগীরের জন্য রেখে দিন।

শেয়ার করুন: