মানবিক গুণাবলি নারীর সবচেয়ে বড় শক্তি

উপমা মাহবুব:

অফিসে তরুণ সহকর্মীর সঙ্গে অলোচনা করছিলাম। বিষয়বস্তু পুরুষ বন্ধুকে ইডেন ছাত্রীর ছুরিকাঘাত। খুব ধৈর্য ধরে গুছিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে বিষয়টিকে আমি পজিটিভ লক্ষণ বলেই মনে করি। আমার মতে সমাজে নারী-পুরুষ সমতার পরিবেশ যত তৈরি হবে, তত বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। নারীরা বছরের পর বছর ধরে এটাই শিখে এসেছে যে তারা অবলা, কোমল প্রাণ, পুরুষের অধস্তন। পুরুষের উপর সরাসরি আঘাত করা কখনোই তাদের প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। পুরুষের মনে যে পশুর বাস, যা তাকে নির্যাতন করতে, এসিড ছুঁড়তে বা হত্যা করতে চালিত করে, নারী হৃদয়ে সেই পশু অবদমিত থাকে।

নারী স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষণ হলো সমাজে পুরুষরা যে কাজ করতে পারে, সেটা নারীরাও করতে পারবে – আমরা যখন এই কথাটি বলি, তখন ধরেই নেই যে শুধু ভালো কাজগুলোর কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে যে ঘটনাটি ঘটবে সেটি হলো, কিছু নারী পুরুষের মন্দ কাজগুলোও নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করবে। ঠিক যেমন এই নারী ঘটিয়েছেন।

আমার তরুণ সহকর্মী কোনভাবেই বিষয়টি মানতে রাজি নন, তার বক্তব্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং যুক্তিসংগত – যেটা খারাপ সেটা সবসময়ই খারাপ, তা নারী বা পুরুষ যেই করুক সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে খারাপ। বললাম, আমি একবারও বলিনি মেয়েটি ভাল কাজ করেছে। সে খুবই খারাপ কাজ করেছে। আর এ জন্য তাকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। যখন নারী-পুরুষের সমতার পৃথিবী হবে, তখন নারীরাও অন্যায় করলে গ্রেপ্তার হবেন, একজন পুরুষের যে শাস্তি হবে, একজন নারীরও সেই একই শাস্তি হবে।

আমি শুধু বলতে চাইছি, আমার কাছে এই ঘটনাটা একটা পরিবর্তনেরই লক্ষণ। এ হলো ‘লক্ষ্মী মেয়ে’র ভাবমূর্তি ভেঙ্গে নারীর ভাল-মন্দ সব ধরনের মানব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠার লক্ষণ।

কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা আমাকে এখন খুব ভাবাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভাল-মন্দ সব মানব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠায় যে মুক্তি, সেই মুক্তি কি সত্যিই আমরা চাই? প্রথমটা ঘটেছে আমেরিকাতে। বাবা-মা তাদের ১৩ সন্তানকে বছরের পর বছর ধরে বিছানার সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তারা পর্যাপ্ত খাবার পায় নি। বছরে গোসল করার অনুমতি ছিল একবার। একেকজনকে তাদের প্রকৃত বয়সের অর্ধেক বয়সী বলে মনে হয়। এই দম্পতির ১৩ বছর বয়সী মেয়ে বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। তারপর পুলিশ তার ভাই-বোনদের উদ্ধার এবং বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করে।

পরবর্তী ঘটনাটা এই বঙ্গদেশের। খবরে দেখলাম ঢাকা শহরে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টের কিছু বাসিন্দা একই অ্যাপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তাকে মারছেন। বৃদ্ধের অপরাধ তিনি গভীর রাতে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে গান বাজানোর প্রতিবাদ করেছিলেন। আমাকে অবাক করলো পিটুনী দাতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারীও আছেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে বৃদ্ধ মানুষটি মারা গেছেন। ঘটনা দু’টোয় নারীর (গ্রামের অবলা, অশিক্ষিত নারী নন, শহরের শিক্ষিত, স্বচ্ছল পরিবারের নারী) ভূমিকা আমার মনকে নাড়া দিয়েছে।

মনে হচ্ছে, নাহ! নারীরাও স্বেচ্ছায় বা প্রয়োজনে অন্যায় করবে, দুর্বলের উপর শক্তি প্রদর্শন করবে, সেটা কখনোই নারী মুক্তির লক্ষণ হতে পারে না। যদি তার সেই কাজের পেছনে অনেক বড় যুক্তি থাকে, যদি সে জন্য পুরুষদের মতো সমান শাস্তি পায়, তারপরও নয়।

নারী অসাধারণ মানবিক গুণাবলির অধিকারী। সেই গুণাবলির কারণেই তারা শান্তির প্রতীক। সে কারণেই প্রকৃতিকে মাতা বলা হয়, নারী হৃদয়কে নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাই আমরা যখন নারী মুক্তির কথা বলি তখন নারীর ভালবাসার ক্ষমতাকে, অপরিসীম ধৈর্য ও উদারতাকে, মিলেমিশে থাকার সহজাত প্রবণতাকে, যুদ্ধের বদলে শান্তি আর ঘৃণার বদলে কল্যাণের পক্ষে তার চির অবস্থানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কথাই বলি।

হতে পারে এই গুণাবলির অনেকগুলোই নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া, হতে পারে যুগে যুগে পুরুষরা চেয়েছে নারী এতোটাই ভালবাসবে যে ভালবাসার পুরুষটির সকল নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করবে। তারা এতোই শান্তিকামী হবে যে, সমাজ বা শ্বশুরবাড়ি ইচ্ছেমতো তাদের উপর অপবাদের বোঝা চাপাবে, সেই বোঝা বইতে না পারলে নারী প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো কথা বলবে না। কিন্তু তারপরও, মমতা, ভালবাসা, সহনশীলতা, সহ্য ক্ষমতা, পরমতসহিষ্ণুতা এগুলো সবই চমৎকার মানবিক গুণ।

আজকে এগুলোর সুযোগ নিয়ে নারীকে অধস্তন করে রাখা হচ্ছে, কিন্তু আগামীকাল যদি এই গুণগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যদি প্রকৃতির মতো অপরিসীম ভালবাসার অধিকারী হয়, নদীর মতো নিজেকে উজাড় করে অন্যের জীবনে সমৃদ্ধি আনে, যুদ্ধের বদলে শান্তির পতাকা উড়ায়, তাহলে আমাদের পৃথিবীটা মানবিক হবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা মিলেমিশে বাস করতে পারবো।

তাই পুরুষতন্ত্র শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে যে পশুত্ব, দমন এবং অন্যায়ের মানসিকতার বীজ পুরুষ জিনে বপন করেছে নারী মুক্তির নামে, সেগুলোকে যেন নিজের মধ্যে গ্রহণ না করি। এতে অরাজকতা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।

নারীর মানবিক গুণাবলিই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই শক্তিকে ব্যবহার করে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে তবেই সমাজে অবস্থান শক্ত হবে। আমাদের একদিকে নারীর মানবিক গুণকে ছোট করে দেখার, সেটিকে দুর্বলতা বলে মনে করার যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

আবার অন্যদিকে (পুরুষ) ক্ষমতায়নের নামে শক্তি ও বল প্রদর্শনের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র সারা বিশ্বে যে অন্যায়ের বিষ ছড়াচ্ছে সেটি থেকেও নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে মানবিক গুণের বিকাশে শুধু নারী নয় বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতিরই মুক্তি নিহিত।

লেখক: উন্নয়ন পেশাজীবী

শেয়ার করুন: