শেখ তাসলিমা মুন:
আমাদের পূর্ণিমা শীল। তাঁকে একজন মন্ত্রী তার অফিসে সহকারি অফিসার হিসেবে চাকুরী দিয়েছেন। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মতের সরবতা। চাকরিটা একজন নারী মন্ত্রী দিয়েছেন আর এক নির্যাতিতা মেয়েকে। এ দুর্ভাগা নারী তাঁর সীমাহীন দুর্ভাগ্য নিয়ে মিডিয়ায় এসেছেন। অনেকের সে ‘ভাগ্য’ পর্যন্ত হয় না।
আমি ধরে নিচ্ছি চাকুরীটা জব অ্যাড, সার্কুলেশন, অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারভিউ, প্রতিযোগিতায় টিকে হয়নি। এটি উন্নত দেশে সম্ভব নয়। প্রতিটি চাকুরী এনাউন্সমেন্টের মাধ্যমে হতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে হতে হবে। তবু ঐ নিয়ম না মানা দেশের অনিয়মে ‘পূর্ণিমা অনিয়ম’কে আমি একটি ‘পজিটিভ ডিস্ক্রিমিনেশন’ হিসেবে দেখতে চাই।
এর পরের প্রশ্ন, মন্ত্রী তারানা হালিম রাজনৈতিক স্বার্থে পূর্ণিমা শীলকে ব্যবহার করেছে কিংবা আওয়ামী লীগ সরকার। হয়তো। রাজনীতিকদের কোনো কাজ ১০০% জনকল্যাণে হয় না। নিজেদের কল্যাণেই বেশি। এখানে সরকারের একজন মন্ত্রী একজন নির্যাতিতাকে এ স্বার্থে ‘ব্যবহার’ করলেন! এ ‘ব্যবহার’গুলো বাড়া দরকার। আর ওদিকে যে পূর্ণিমা ‘ব্যবহৃত’ হলো, তাঁর জীবন কেমন চলছিল আমরা খোঁজ নিয়েছি কি?
আচ্ছা, পূর্ণিমা শীল কত বছর ধরে সাফার করে যাচ্ছে? কিশোরী পূর্ণিমার উপর যা ঘটেছিলো, তা বাংলাদেশে ঘটে। প্রায়ই ঘটছে। পূর্ণিমা এইসব ভয়াবহ ঘটনার একটি ‘মুখ’। একটি রক্ত মাংসের মুখ। যে ঘটনা অহরহ ঘটছে সেগুলো আমাদের কাছে পত্রিকার কালো অক্ষরের বেশি হয় না। একজন পূর্ণিমা আমাদের কাছে এইসব নিয়ত ঘটনার একটি ফেইস।
আমি নিজেই মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করেছি, কতটা বীভৎসতা মোকাবেলা করেছিলো সেই ছোট্ট মেয়েটি? এই মেয়েটি! মৃত্যুর দরোজা থেকে ফিরে এসে মেয়েটি যুদ্ধ করে গেছে। নিজেকে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থেকেছে। বাবা-মা পরিবার নিয়ে ঢাকায় সারভাইভ করতে তাঁকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হচ্ছিল। আমি তো মনে করি, সারাদেশের হাজার লক্ষ পূর্ণিমার প্রতিনিধি হিসেবে সে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে, একটি অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজটি সম্পন্ন হবার অপেক্ষায় ছিল।
এটি করতে কেন অন্য অর্গানাইজেশন এতদিন এগিয়ে আসেনি। আমি যতদূর জানি ঢাকার অনেক মানবিক সংগঠনের স্নেহ ছিল পূর্ণিমার উপর। কিন্তু বিবিসিই কেবল এগিয়ে এসেছিল একটি ইন্টারভিউ নিয়ে আমাদের জানাতে, মেয়েটি কেমন আছে, কোথায় আছে। আমি নিজেই অনেকবার ভেবেছি, কোথায় গেল পূর্ণিমা? বিবিসির মাধ্যমে আমি জেনেছিলাম তাঁর অস্তিত্ব বিষয়ে। তাঁকে একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত অফিসার হতে হবে কেন? তাঁকে কাজ দেওয়ার মতো কোন সংগঠন, প্রাইভেট বা পাবলিক সেক্টরে ছিল না? কেউই কি এগিয়ে এসেছিল? আজ যে কাজটি পেলো, সেটির মেয়াদ বেশি নয়। যত বড় কাজই হোক, নির্বাচনের পর তাঁর কাজ থাকবে কিনা কেউ জানে না।
তবু তাঁর সামনে অন্তত একটি পথ উন্মুক্ত হয়েছে। আর আমি তো মনে করি ভাগ্যিস তারানা হালিমের মন্ত্রনালয়ে তাঁর কাজটি হয়েছে। কাজটি তারানা হালিম না দিয়ে যদি ওবায়দুল কাদের দিত, তাহলে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে রি রি পড়ে যেতো। খুব দ্রুত মেয়েটির নামে এসব ছড়ানো সহজ। এদেশে একজন ধর্ষণের শিকার মেয়ে ‘পতিতা’র সামিল (আমায় ক্ষমা করিস বোন)! ভাগ্যিস তারানা হালিম একজন নারী।
জাতি হিসেবে আমাদের cynicism এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
——————————————————————————————————————–
ফেসবুকে এখন একটি ছবি খুব ঘুরছে, প্রণব মুখার্জী একটি চেয়ারে বসে আছেন। অন্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। তাতে বাংলাদেশের দাসত্ব প্রমাণ হয়েছে। উনি ‘দাদাগিরি’ করতে এসেছেন। এই চেয়ারের বসার গল্প এ দেশে আছে। বেগম খালেদা জিয়া পিঠে সিংহাসন নিয়ে ঘুরেন। তাঁর হাঁটুতে ব্যথা। দাঁড়াতে পারেন না বেশিক্ষণ। পা ভাঁজ করে বসতেও পারেন না। তিনি আবার যে সে চেয়ারেও বসতে পারেন না। অগত্যা একটি সিংহাসন তাঁর সাথে সাথে চলে।
একবারও কি ভেবেছেন, প্রণব মুখার্জী ভদ্রলোকের বয়স কত? হেলথ কন্ডিশন? আশির উপরে তাঁর বয়স। কেন তিনি একা একটি চেয়ারে বসে আছেন? তাঁর মুখে কি কোনো উগ্রতা ছিল? ভদ্রলোক কি এবারই এদেশে প্রথম এলো? এ দেশের একটি গ্রামে এখনও তাঁর স্ত্রীর বাবার ভিটে।
আর এই বসা আর দাঁড়ানোর ভেতরে জড়ো হয়ে গেল সকল সম্মান?
ভারত কোনো নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চা নয়, আমি জানি। কিন্তু ভারতের নাম উঠলেই একটি শ্রেণী যে লাফ দিয়ে ওঠে এবং বিদ্বেষ ছড়ানর কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করেন তারা খুব দেশপ্রেমিক তা কিন্তু নয়। তাদের ভেতর আছে সাম্প্রদায়িকতা আর ঘৃণা ও বিদ্বেষের বীজ ছড়ানোর অ্যাজেন্ডা।
যেকোনো আলোচনা গঠনমূলক পদ্ধতি এবং বিষয়বস্তু নিয়ে হবে সে এখন বিরল ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনা আর সমালোচনা এখন সিনিক্যাল পর্যায়ে। এটা একটি অসুখ। এ অসুখের নাম cynicism! Cynicism এখন আমাদের জাতীয় অসুখ! আমরা এখন জাতিগতভাবে সিনিক্যাল।