দূর পরবাসে অপরাজিতা

ফারজানা আকসা জহুরা:

প্রতিদিন সকালে বানানো গরুর খাঁটি দুধের চা ঐ কাপে পড়ে থাকে। দিনে বহুবার খাবো বলে ওভেনে গরম দেই। কিন্তু খাওয়া আর হয় না। কতদিন চা খেতে খেতে গান শোনা হয় না। না, একটা সিনেমা দেখতে পেরেছি।

মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশেই ভালো ছিলাম। হাজার সমস্যার মাঝেও ছোট-বড় অনেক সুখ ছিল। মন খারাপ হলে রিক্সায় করে ঘুরতে পারতাম। বৃষ্টি হলে ভিজতে পারতাম। যখন-তখন চটপটি, ফুচকা আর হালিম খেতে পারতাম। এই দেশে এতো এতো দামি খাবারের ভিড়ে কেন জানি বাংলাদেশের ঐ সস্তা আর ভেজাল খাবারই মিস করি ভীষণ। বৃষ্টির দিনে পেঁয়াজু আর বিকালে সিঙ্গাড়া খাওয়ার জন্য মনটা খুব ছটফট করে! কিন্তু এইসব দেশে সেইসব সুযোগ কই! নিজে বানাও, নিজেই খাও। ছোট দুইটা বাচ্চা নিয়ে এতো ঝামেলা কে করে বলুন তো!

ছোটবেলায় আমার ইচ্ছে ছিল উকিল হওয়ার। তর্ক-বিতর্ক করতে খুব পচ্ছন্দ করতাম। সবাই বলতো, আমি উকিল হলে ভালো করবো। এসএসসি আর এইচএসসি দুটোতেই তিন-চারটা লেটারসহ মানবিক বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে ছিলাম। এরপর যখন আইন বিভাগে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি, তখন খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল আমার জীবনটাই বুঝি শেষ।

কিন্তু জীবন কি আর থেমে থাকে? তাই ভাবলাম খুব ভালো ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। ৬/৭ বছর পড়াশোনা শেষে যখন সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না, তখনও খুব হতাশ হয়ে ছিলাম। কিন্তু হার মানিনি। ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকলাম। পেলামও বটে, একটি প্রতিষ্ঠিত NGO মোটামুটি ভালো পদে চাকরি। খুব ইচ্ছে ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার, কিন্তু NGO চাকরিটা বিসিএসের চাইতে বেশি দরকারি ছিল।

ঠিক করলাম পিএইচডি করবো। কারণ পিএইচডি করলে আরো ভালো পদের চাকরি পাওয়া যাবে। শুরুটাও ভালোই ছিল। এমফিল প্রথম পর্বে আবারও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম। তাও প্রথম! অর্থাৎ পিএইডি করার সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু তা আর পারলাম কই! এক বছরের মধ্যে বাবা-মায়ের মৃত্যু! তখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগতো না। মনে হতো, এই জীবনের কোনো মানে হয় না!

জীবন আসলে কখনও কোনকিছুর জন্য থেমে থাকে না। জীবনকে চালিয়ে নিতে, বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে আবার নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে হয়। আমিও তাই করলাম। যেই আমি ইউরোপের স্বপ্ন কখনো কল্পনাতেও কল্পনা করিনি, সেই আমাকেই বৈধতা নিয়ে ইউরোপে আসতে হলো। হলাম ইউরোপের স্থায়ী বাসিন্দা! জীবনটা আবার শুরু করতে হলো প্রথম থেকে। নতুন দেশ। নতুন পরিবেশ। নতুন ভাষা। নতুন মা হওয়া। আর এতো এতো নতুনের মাঝে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা।

অনেকেই বলে বিদেশে এতো সুযোগ, চাকরি করছি না কেন! তখন মনটা ভীষণ খারাপ হয়। বলি, আরে ভাই, অনেক তো জীবন সংগ্রাম করলাম। এখন না হয় বাচ্চা দুটোকে একটু বড় করি। আমার বাচ্চা তো আর অন্য কেউ এসে মানুষ করে দিবেন না। আর নিজের সন্তানকে মানুষ করাও তো একটা বড় ধরনের কাজ, কি তাই না?

আর কষ্ট যে শুধু আমি করছি, তা কিন্তু না। আমার সঙ্গী প্রতিদিন সকালে কাজে যায়, আসে মধ্য রাতে। অসুস্থ শরীরেও তাকে কাজে যেতে হয়, কারণ একটা ভালো আর উন্নত মানের কাজ সহজে পাওয়া যায় না। অনেকেই ভাবেন বিদেশ মানেই কাড়ি কাড়ি টাকা। হ্যাঁ, কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। যারা সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে ভাতা খায়, তাদের কাছেই বিদেশ মানে কাড়ি কাড়ি টাকা। কিন্তু সবাই কি এতো চালাকি করতে পারে? তাই যারা সরকারি ভাবে আয়-রোজগার করে, তাদের ক্ষেত্রে কথাগুলি প্রযোজ্য নয়। তবে এটা ঠিক, এইসব দেশে সরকার অনেক সামাজিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। যার মধ্যে চিকিৎসা আর শিক্ষা অন্যতম।

চলতি পথে অনেক বাঙালিকে দেখি যাদের এখনো কাগজ হয়নি। হয়তো তাদের জীবন সংগ্রামটা আমাদের চাইতে আরও বেশি কঠিন। তবুও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো হার মানেনি। আবার অনেক মানুষের কথা শুনি, যারা আর জীবনের যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে পারছে না। জীবন নিয়ে তারা খুব হতাশ হয়ে পড়েছে। আশপাশে আত্মীয়-পরিজন কিংবা আগলে রাখার মতোন কোনো বন্ধু না থাকায়, কেউ বা অতল গহিনে হারিয়ে যাচ্ছে!

আর এই সবের বিপরীত কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ আছে, যারা সবকিছু খুব সহজে এবং তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছে। কোনো ধরনের সংগ্রাম ছাড়াই অর্জিত টাকা আর কাগজ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নাই। এদের কাছে ইউরোপ হলো একটি ফুলের বিছানা! খালি সুখ আর সুখ! এইসব দেশে কোনো কষ্ট করতে হয় না। এইসব দেশের আকাশে-বাতাসে শুধু টাকা উড়ে!

আসলেই কি তাই? ইউরোপ কি একটি ফুলের বিছানা? এইসব দেশে কি সবার স্বপ্নই পূরণ হয়? নাকি ধৈর্য্য আর কঠোর পরিশ্রম করেই কেবল সফলতা লাভ করা সম্ভব। অবশ্য যারা খুব সহজে জীবনে সফলতা অর্জন করেছে, কেন জানি তাদের কাছে অন্যের বেঁচে থাকার লড়াইটা হাস্যকর বলেই মনে হয়। এরা নিজেদের সৌভাগ্যকে যোগ্যতা আর অন্যের দুর্ভাগ্যকে অযোগ্যতা বলে মনে করে।

সত্যি বলতে কী, যদি আমাদের দেশে দুর্নীতি না থাকতো, যদি বেকার সমস্যা না থাকতো, যদি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পেতো, তাহলে এতো মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার স্বপ্নে বিভোর হতো না। না সোনার বাংলা ছেড়ে প্রবাসী হতে চাইতো। যে পরিশ্রমটা আমাদের প্রবাসে এসে করতে হয়, তা দেশে করলেই দেশের অনেক উন্নতি হতো। কিন্তু সেই সুযোগটা আমাদের দেয় কে? দেশে বিদ্যমান দুর্নীতি, লুটপাট, অব্যবস্থাপনা, অনিরাপত্তা ও সামাজিক বৈষম্য এই সবকিছু আমাদের মতো মানুষদের প্রবাসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

কারণ যেটাই হোক, নিজের দেশ নিজের পরিবার আর নিজের মাতৃভাষা ছেড়ে কি অন্য কোথাও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়? তবুও তো বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে নিতে হয়।

জীবনে সুখী হতে হলে নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে। নিজের চোখে নিজের জীবনকে দেখতে হবে। অন্যের চোখে নিজের জীবনের মানে খোঁজা একটা বোকামি। জীবন মানেই তো অবিরাম চলতে থাকা, পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝেই জীবনের সুখ খুঁজে নেওয়া।

শেয়ার করুন: