হাতড়ে ফিরি শৈশবকে

কানিজ আকলিমা সুলতানা:

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা শীতের ছুটিতে আমরা গ্রামের বাড়ি আশুগঞ্জের সোহাগপুরে যেতাম। তখনও কমলাপুর ষ্টেশন তৈরি হয়নি। ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) ষ্টেশন থেকে গ্রীনএরো নামক ট্রেন ছাড়তো দুপুরে। সেই ট্রেনে আমরা যেতাম। তখন আন্তঃনগর ট্রেন ছিল না। লোকাল ট্রেনের মত সব ষ্টেশনে না থামলেও গ্রীনেএরো বেশ কিছু ষ্টেশনে থামতো। তাই আশুগঞ্জ পৌঁছাতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যেতো। ষ্টেশনের লন্ঠনের আলোয় প্রতিবার ষ্টেশনটাকে আমার অচেনা লাগতো। সাদা প্যান্ট আর কালো কোট পরা টিকেট চেকারকে ভীনদেশি মনে হতো।

বিশাল মেঘনার উপর ভৈরব সেতু পার হতেই আশুগঞ্জ ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মের শুরু। ছোট একটা ষ্টেশন। চারদিক খোলা। সেতুর লেভেলে বলে সমতল থেকে অনেক উঁচুতে। খাঁড়া পয়তাল্লিশটা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলে রাস্তা। আশুগঞ্জ পৌঁছে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলে দেখতাম শীতের সন্ধ্যায় রিকশাচালকরা গামছায় নাকমুখ ঢেকে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে।

দাদাবাড়িতে তখন অনেক লজিং থাকতো। তাদের কেউ কেউ আসতো আমাদের নিতে। তাদের পিছন পিছন কুলি আমাদের ব্যাগ স্যূটকেস নামিয়ে নিয়ে রিকশায় তুলতো। একজন ছোটখাট মানুষ বাড়ির বাচ্চাদের আরবী পড়াতো। সবাই তাকে ‘বাইট্টা মুন্সী’ ডাকতো। এই মুন্সীকে ষ্টেশনে দেখলেই আমার রূপকথার বামন মানুষদের কথা মনে পড়তো। ষ্টেশনের আলোআঁধারিতে বাইট্টা মুন্সী, কালো কোটের চেকার আর নাকমুখ ঢাকা রিকশাচালকেরা প্রতিবার সোহাগপুরে যাওয়ার আগে আমাকে এক রূপকথার রাজ্যের ভয়ের অংশে চালান করে দিত। বড়দের হাত ধরে সিঁটিয়ে থাকতাম আমি।

রিকশা চলতো আশুগঞ্জ বাজারের গলি, তস্য গলি দিয়ে। বাজার থেকে বেরিয়ে হাতের বামে নদীর পাড়ে অনেক গুদাম ঘর ছিল। এই জায়গাটায় এলেই বিকট এক গন্ধ এসে নাকে ঢুকতো। এখানে পশুর হাড় জমা করে রাখা হতো। বিশাল হাড়ের স্তুপ। কোথা থেকে এত হাড় আসতো কে জানে! সার তৈরির জন্য বা অন্য কোনো কাজের জন্য এখান থেকে হয়তো মালগাড়িতে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো এইসব হাড়। হাড়ের পাহাড় পেরিয়ে কিছুদূর এগুলেই মেঘনার উপর একটা জেটি। বার্জ বা মালবাহী জাহাজ থেকে মালামাল লোড আনলোড করার জেটি। জেটির কাছে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়তে হতো আমাদের।

তখনও বাড়ি অবদি রিকশা চলার উপযোগী রাস্তা ছিলনা। গ্রামের ভিতরের মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দূরের বাড়িগুলোতে হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো দেখা যেতো। কুয়াশা গায়ে মেখে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আমরা গ্রামের পথে হাঁটতাম। আমি একটু ভীতু টাইপও ছিলাম। কুয়াশার স্তর ভেদ করে এই ছোট ছোট আলোর উৎসগুলোকে আমার কাছে তখন ভূতের চোখ মনে হতো! রাস্তার পাশের বাঁশের ঝাড়ে পেঁচা ডাকলে গা শিউড়ে শিউড়ে উঠতো। বারবার মনে হতো পথ ভুল করে আমরা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি!

দাদার বাড়ি পৌঁছে দেখতাম উন্মুখ হয়ে দাদা দাদী, চাচা চাচী আর চাচাতো ভাইবোনেরা আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। চারদিকে হ্যারিকেন জ্বালানো। সবাই আনন্দে হইচই করতে শুরু করতো। শুধু আমার ভয় তখনও আমাকে ছেড়ে যেতোনা। হ্যারিকেনের আলোয় সবার দীর্ঘ ছায়া পড়তো বিশাল বিশাল আলমারীর গায়ে। আলমারীর গায়ে নানান কারুকাজে আলো পড়ে ভৌতিক সব আল্পনা তৈরি হতো। বড় বড় চেয়ারের পায়া আর হাতলের প্রান্ত ছিল বাঘের মুখের আদলে খোদাই করা। দেয়ালে সারসের বিশাল লম্বা শুকনো ঠোঁট আর অন্যসব ধাতব বস্তু আমায় কেবলই ভয় দেখিয়ে চলতো!

যখনকার কথা বলছি তখন বেড়াতে যাবার গ্রুপে আমি বেশ ছোট। বড়রা আমার খেয়াল রাখতো তবে ওরা কেউ আমার ভয়ের কথা জানতোনা। প্রথম রাতে ক্লান্ত বলে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তো। আমি দাদীকে জড়িয়ে ধরে তাঁর আয়না লাগানো নকশাকাটা রেলিংঘেরা পালঙকে শুয়ে পড়তাম। ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে শুনতাম টিনের চালে কুয়াশা পড়ার শব্দ। গ্রামের গহীন নৈঃশব্দে এইসব শব্দে আমি আরও ছোট হয়ে দাদীর গায়ে লেপ্টে থাকতাম।

একসময় ঘুম ভেঙ্গে যেত ঘরের সাথে লাগানো কবুতরের ঘর থেকে ভেসে আসা বাকবাকুম বাকুম ডাকে। কী মধুর করে যে ডাকতো ওরা! চোখ খুলে দেখতাম ভোরের আলো ঢুকছে খোলা দরজা দিয়ে। দাদা দাদী উঠে পড়েছে নামাজের জন্য। তখনই শুরু হতো আমার সুপ্রভাত। রাতের ভয় থেকে আলোর আনন্দে ঢুকে যেতাম আমি। দাদা শব্দ করে নামাজের সুরা পড়তো। গুটি পায়ে বাইরে এসে দেখতাম বড় চারমুখ চুলায় গনগনে আগুনে চাচী পিঠা বানাচ্ছে। চুয়া পিঠা, পোয়া পিঠা, ঢুপি পিঠা। ততক্ষণে বাড়ির সব বাচ্চারা চাদর গায়ে বাইরে চুলার পাশে ভিড় করেছে। বড় একটা হাঁড়িতে পানি ফুটতো। তাঁর উপর বসানো ছিদ্র ছিদ্র চুয়া পিঠার হাড়িতে স্তরের পর স্তর পিঠা দেয়া হতো। ভাপে সিদ্ধ হতো ওই পিঠা। এক হাড়ি পিঠা সিদ্ধ হয়ে গেলে বাঁশের বড় একটা খাঁড়িতে পিঠা ঢালা হতো। চাচী চিকন শোলা (পাটখড়ি) ভেঙ্গে দুইপাশে দুইটা ধোঁয়া ওড়া পিঠা গেঁথে বাচ্চাদের হাতে দিত। সবাই ফুঁ দিয়ে পিঠায় কামড় দিতে দিতে শীত তাড়াতে আরও খানিকটা চুলার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতো।

আমরা যারা শহর থেকে যেতাম তারা সোয়েটার পরতাম। তাই শীত আমাদের তেমন কাবু করতে পারতো না। আমি পিঠা হাতে বাড়ির পুকুরের উত্তর পাড়ে যেতাম। পুকুরের এই পাড়টার পরে আর বাড়িঘর নেই। দূরের মেঘনা পর্যন্ত দিগন্ত বিস্তৃত সর্ষের ক্ষেত হলুদ হয়ে থাকতো ফুলে ফুলে। হুহু ঠান্ডা বাতাসে সর্ষে ফুলের গন্ধ ছোট্ট আমাকে বিভোর করে রাখতো।

আগের রাতের ভূত নগরী থেকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমি পৌঁছে যেতাম অপরূপ এক ভুবনে যেখানে রূপ রস গন্ধ স্পর্শ গভীর থেকে গভীর মনে হতো, সেখানে পুকুরের স্থির জলে কুয়াশার ধোঁয়া ওড়তো, ফিঙ্গে শালিক কবুতরের দল উঠোনে আলো ছড়াতো, আর আমি ভেবে নিতে থাকতাম, এই গ্রাম ছেড়ে আমি আর শহরে ফিরে যাবো না।

শেয়ার করুন: