মোল্লাতন্ত্রের শিকার যখন কৃষাণি

ফাহমি ইলা:

প্রথম আলোর ১২ ডিসেম্বরের একটি খবরে চোখ আটকে গেছে। খবরটি বলছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কল্যাণপুর জামে মসজিদের মাইক থেকে গত শুক্রবার ৯ ডিসেম্বর ‘ফসলের ক্ষতি’ ও ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’-এর অজুহাতে নারীদের মাঠে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর আগে নারীদের মাঠে যাওয়া বন্ধ করতে বৈঠক হয়।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তা মাইকে কয়েক দফায় ঘোষণা করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কল্যাণপুর জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলতাফ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান, মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক আজাদী, পেশ ইমাম আবু মুছা, সহসভাপতি মজিবর রহমান প্রমুখ। মাইকে কয়েক দফা নারীদের মাঠে যাওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রচার করেন ওই মসজিদের মুয়াজ্জিনের ছেলে রুহুল আমিন সেখ।

এ ধরনের খবরে মাথা ঠাণ্ডা রাখা কিঞ্চিত কষ্টকর। এ ধরনের ফতোয়া দেবার অধিকার কারো আছে কীনা সে প্রশ্ন করবার আগে প্রশ্ন করতে হয়-‘এ ধরনের ফতোয়া দেবার যে সাহস প্রয়োজন, তার উৎসমুখ কোথায়?’ ‘ফসলের ক্ষতি’ নারীর জন্য হচ্ছে এহেন অবৈজ্ঞানিক যুক্তি যখন ২০১৭ সালে এসেও দেয়া যায়, তখন ভাবতে বাধ্য হই-‘আমরা কোথায় আছি!’ আর ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ বন্ধের দোহাই দিয়ে নারীকে ঘরের ভেতর পুরে দেয়ার ফন্দি আঁটাতো আজকের প্রক্রিয়া নয়!

যারা এই ধরনের ফতোয়ার পক্ষে, তাদের সাথে বাতচিতের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না রেখেই কিছু তথ্য নিচে তুলে ধরি-

কৃষি মানুষের আদিম পেশাগুলোর একটি। আর এ কাজের সাথে আদিমকাল থেকে জড়িত আছে নারী। একটি প্রবাদ আছে ‘Agriculture is the Pioneer of all culture and Women is the pioneer of Agriculture’। সৃষ্টির শুরু থেকে নারী কৃষিকাজকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে আজ অবধি।
বাংলাদেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষদের মধ্যে কতভাগ নারী আর কত ভাগ পুরুষ কেউ বলতে পারেন? বাংলাদেশে ৫ থেকে ৬ কোটি নারী কৃষিকাজের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। জনসংখ্যার মোট নারীদের মধ্যে ৭১.৫% কৃষি কাজে নিয়োজিত আর সে তুলনায় ৬০.৩% পুরুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন।

কৃষিকাজ মানে হাঁটুর ওপরে লুঙ্গি, কোমরে গামছা নিড়ানি হাতে লাঙল জোয়াল সমেত পুরুষ কৃষকটি নয় কিন্তু! কিন্তু কৃষক বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এই চিত্রই! কৃষিকাজের ভেতর ২০ রকমের কাজ নারীরা করে থাকে। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে মাঠে ফসল ফলানো, মাঠ থেকে ফসল আনার পরে সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ঘরে তোলা এমনকি বিপণন এই পুরো প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা অনেক বেশি। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী।

কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা ও অবদান ব্যাপক ও বিস্তৃত। একটি উৎস থেকে নারীর অনেক অবদানের মধ্যে কিছু অবদান তুলে ধরছি- বীজ সংরক্ষণ; বীজ বাছাই, শোধন ও অঙ্কুরোদগম বীজ শোধন; বীজতলায় বীজ বপন; চারা তোলা; চারা রোপণ; কৃষি পঞ্জিকা পুষ্টিসম্মত রান্না কৌশল; খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ; কর্তন উত্তর কৌশল; শস্য সংরক্ষণ; কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা; কৃষি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা; জৈবকৃষি; মুরগি পালন; হাঁস পালন; ছাগল পালন; গরু পালন; দুধ দোহন; গরু মোটাতাজাকরণ; ডিম ফোটানো; হাঁস-মুরগি পালন; বসতবাড়িতে শাকসবজি ফল ফুল চাষ; ভেষজ চাষ; কবুতর পালন; কোয়েল পালন; নার্সারি ব্যবস্থাপনা; মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনা; মৌচাষ ; শীতল পাটি হোগলা তৈরি; অঙ্গজ বংশবিস্তার; বায়োগ্যাস কার্যক্রম; বনসাই/অর্কিড/ক্যাকটাস চাষ; কুল বার্ডিং; খাঁচায় মাছ চাষ; পুকুরে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ; জ্যাম জেলি আচার কেচাপ স্যুপ আমসত্ত্ব তালসত্ত্ব; মাছের সাথে হাঁস-মুরগির চাষ; ভাসমান সবজি চাষ; ঘাস চাষ; উন্নত চুলায় রান্না; কুটির শিল্প; মাশরুম চাষ; আলুর কলার চিপস; চানাচুর তৈরি; ছাদে বাগান; বাহারি মাছ; পারিবারিক শাকসবজি সংগ্রহ; পারিবারিক শাক ফলমূল সংরক্ষণ; জ্বালানি সংগ্রহ; কৃষি বনায়ন; সামাজিক বনায়ন…। এর সবগুলোতেই নারী সংশ্লিষ্ট। কোনটাতে এককভাবে আবার কোনটাতে যৌথভাবে। এই যে কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ এদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ নারীর শ্রমের কোন স্বীকৃতিই নেই, এরা পারিবারিক নারীশ্রমিক!

সম্প্রতি এফএও’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে এ খাতে শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী।

ওপরের তথ্যগুলো বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে নেয়া। যাদের কাছে পৃথিবী মানেই ৮৩,১২০ বর্গমাইলের একটি মরুভূমি, তাদের কাছে এ ধরনের ফতোয়া অবান্তর নয় বৈকি! এদের মগজ মননের সংকীর্ণতা নারীকে করে তুলবে আরো কোণঠাসা!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যেহেতু সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী কৃষিকাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, সেহেতু ‘ফসলের ক্ষতি’ কি নারী সৃষ্টির শুরু থেকেই করে আসছে? আর এই ক্ষতি নিয়েই পৃথিবী এগিয়ে গেলো ২০১৭ সাল অবধি!

এ ধরনের ঘোষণা কী রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সরকারের ভিশন ২০২১, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির সাথে যায়? যদি না যায় তাহলে এ ধরনের ফতোয়াবাজেরা নিঃসন্দেহে সরকারবিরোধী, সভ্যতার পশ্চাৎপদতায় অগ্রসরগামী এবং নিঃসন্দেহে অন্ধকারবাসী। এদের সকল ফতোয়ার নল সবসময় উদ্ধত থাকে নারীর প্রতি। কারণ এরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় নারীকে, কেননা যুগ যুগান্তরে এরা নারীদের প্রতিই নির্বিচারে শোষণ চালিয়েছে। এরা ভালোমতো জানে-‘নারী যদি জাগে, তবে এদের মৃত্যু অবধারিত!’

সরকারের উচিত এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার সাথে সাথে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া যে ভবিষ্যতে যারাই এ ধরনের মহাবয়ান দেবার চেষ্টা করবে তাদের প্রতি যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শেয়ার করুন: