একাত্তর আমার মায়ের রক্ত, সর্বস্ব হারানোর স্মৃতি

লুৎফুন ভুঁইয়া হেনা:

যুদ্ধ শুরুর আগে আগেই বাবা আমাদের চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন নিরাপত্তার জন্য। এর মধ্যে আমার ভাইকে মা যুদ্ধে পাঠালেন। বাবাও কাছে নেই। চার বোন আর দুই ভাইকে নিয়ে মা বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।

বাবা রেলওয়েতে কাজ করতেন। মা তার সংসার চট্টগ্রাম ফেলে এসেছেন। বিষাদ ভরা মন। ছেলে যুদ্ধে, তার জন্য মায়ের মন অস্থির। আমরা নোয়াখালী আসার কিছুদিনের মধ্যে আমাদের চট্টগ্রামের বাসা লুট হয়। এমন সব অনিশ্চয়তার মধ্যে আসে উত্তাল মার্চ।

আমাদের বাড়ি থেকে প্রথম সশস্ত্র হামলা করে বাড়ির ছেলেরা। সেই থেকে আমরা পাক আর্মিদের কড়া নজরে পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড অভাব তখন। একবেলার বেশি আমাদের খাওয়া জুটতো না। এর মধ্যেই আমার মা রুটি বানিয়ে পানির জগ দিয়ে আমাদের রাস্তায় পাঠাতেন, যেন মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই খেতে দেই। পাক আর্মিরা বাড়ির সামনের রাস্তায় টহল দিতো।

এমনি এক রাতে আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। পাক আর্মি আমাদের বাড়ি ঢুকে সমস্ত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। ঘুমের মধ্যে দেখি, আমাদের চারপাশে আগুন আর আগুন। মা আমাদের নিয়ে কোনরকম জানে বাঁচলেন সে যাত্রা। হারালাম আমরা যেটুকু সম্বল ছিল তাও। কাছের আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিলাম আমরা। কতদিন আর অন্যের বাড়ি থাকা যায়! ফিরে এলাম আমরা বাড়িতে। পোড়া টিন দিয়ে ছাবড়া বানিয়ে আবার আমরা থাকা শুরু করলাম। পাক বাহিনীর সাথে সাথে তখন রাজাকারের উৎপাতও বাড়লো।

এমনি এক দিন।

১১ ই জুন। বিকাল চারটা। আম্মা চা বানাচ্ছেন। বড় বোন চাল ধুতে পুকুরে গেছে। মেজো বোন বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িতে গেছে খাওয়ার পানি আনতে। আমরা ছোট দুই বোন খেলছিলাম। এক ভাই গেছে বাজারে। ছোট ভাইটাও খেলছিল।

এমন সময় পাকবাহিনী আমাদের বাড়ি ঢুকলো। মা আমাদের ছোট দুই বোনকে কোলে তুলে পুকুর পাড়ে বেত গাছের নিচে পালালেন। বড় আপা আরেক ঝোঁপে। মেজো বোন বাড়িতে আর্মি দেখে বাড়ির পাশের খালের মধ্যে নৌকা দেখে ভয়ে তাতে উঠে পড়লো। ছোট ভাইটা লুকালো ধান ক্ষেতের ভেতর। এভাবে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আর্মি আমাদের পুরো বাড়ি ঘেরাও করলো। সমস্ত পুকুর পাড় ঘিরে শুরু করলো এলোপাতাড়ি গুলি। আমার মা আর এক কাজিন গুলিবিদ্ধ হলো। আমি আর আমার ছোট বোন মায়ের পাশে ছিলাম। আমি পুকুর থেকে পানি এনে মায়ের মুখে দিয়েছি। বুকের যেখানে গুলি ঢুকেছে আমার ছোট্ট হাত দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি তা বের করতে। মা মারা গেল। আমার বড় বোনকেও আর্মিরা চেষ্টা করেছে ধরে নিয়ে যেতে, অল্পের জন্য সে বেঁচে গেছে। ভাংগা ভাংগা উর্দুতে সে বলেছে, সে অনেক ছোট। পুকুরের ফেনার মধ্যে সে তার শরীর লুকিয়ে রেখেছিল।

সেদিন পাক আর্মিরা আমাদের গ্রামে মোট ২৪ জনকে মেরেছে আর অগণিত মেয়েকে ট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছে। আমার মা সেখানেই পড়ে রইল। কোন মানুষ ছিল না আমার মায়ের লাশ তোলার। আমার চার নাম্বার ভাই বাজার থেকে রেল লাইন দিয়ে শুয়ে শুয়ে দুই মাইল রাস্তা পার হয়ে বাড়ি এসে মাকে তুলে আনলো পুকুর পাড় থেকে। পরের দিন মায়ের দাফন হলো। দাফন শেষ হবার সাথে সাথে আবার আমরা পালালাম। জুন মাস চার পাশে পানি আর পানি। ভাইয়ের কাঁধে চড়ে এক বুক পানি ভেংগে আবার আমরা আত্মীয়ের বাড়ি আসলাম। শুধু সিদ্ধ মিষ্টি আলু খেয়ে আমাদের সেই দিনগুলি কাটতো।

চারদিন পর আমার বড় দুই ভাই বাড়ি আসলো। এসে শুনলো আম্মার মৃত্যুর কথা। আমাদের কোনো খোঁজ নেই। এক মাঝির কাছ থেকে জানলেন আমরা কোথায় আছি। গভীর রাতে আমার ভাই নৌকা ভাড়া করলেন। আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলেন। চাঁদপুর হয়ে চারদিন নৌকায় খাওয়া-দাওয়া ছাড়া পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা বিক্রমপুর আমার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি এসে আশ্রয় নিলাম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.