আনা নাসরীন:
বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা যোগান তত্ত্বটি চিরন্তন। সমাজে যা কিছুর চাহিদা থাকবে, বেনিয়ারা তারই যোগান দিয়ে বাণিজ্যিক সুবিধা নেবে এটাই স্বাভাবিক। কথাটা মনে হলো, রোবটের গায়ে ওড়না চড়ানোর খবরটি দেখে। আমাদের সমাজের অনেক মানুষ নারীর অঙ্গে, এমনকি রোবটের গায়ে ওড়না দেখে যেহেতু খুশি হয়, তাই রোবটের গায়ে ওড়না উঠারই কথা; চাহিদা থাকলে রোবটকে আমরা হিজাব-নেকাব এ আবৃত অবস্থায়ও দেখতে পারি।
রোবটের গায়ে ওড়না জড়ানোতে দেখতে পাচ্ছি আমাদের অনেকেরই টনক নড়েছে; হয়তো আমাদের নৈতিকতার মানদণ্ডে এটাকে খুব আপত্তিকর বলে মনে হয়েছে। তাই অনেককেই দেখছি রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকে বিকৃত মানসিকতার বলে দাবি করছে। অথচ রক্ত মাংসের মানুষকে যখন এই বাড়তি কাপড়ের টুকরোয় মুড়িয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে, যা চলছে এখনও, তখন কিন্তু আমাদের মনেই হয়নি এটা বিকৃতি, মনে হয়নি যে এভাবে মানুষকে অসম্মান করা হয়।
অতিরিক্ত মোড়কজাত করে আমরা যে কেবল নারীকে অসম্মান করেছি তাই নয়, আমরা পুরুষকেও ভীষণভাবে অসম্মান করেছি; পুরুষের প্রতি দেখিয়েছি অনাস্থা। ওড়না পরিহিত মেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় চলাচলের সময় গায়ে মেলে রাখা ওড়নাটি বার বার করে চেক করে নেয়। যদি অসচেতনতায় সামান্য সরে গিয়ে থাকে এই ভেবে বার বার একটু টেনে টুনে নেয়, এটি অত্যন্ত কমন একটি প্র্যাকটিস। এটি এতোটাই প্র্যাকটিসড যে, এই কাজ মেয়েদের খুব সচেতনভাবেও করতে হয় না, অবচেতনেই হাতটি এই কাজ করে। এটি প্রমাণ করে যে মেয়েরা পুরুষদেরকে ডাস্টবিনের আবর্জনার চেয়েও নোংরা রূপে বিবেচনা করে।
এই অসম্মান পুরুষরাও কিন্তু মেনে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে! আচ্ছা মনে করি ঘটনাটি যদি উল্টো হত, আমাদের সমাজে পুরুষরা নারীর ওপর অনাস্থা রেখে নিজেদের যদি একইভাবে বাড়তি কাপড়ে সংরক্ষণ করে রাখতো তাহলে কিন্তু আমি নারী হিসেবেও ভীষণ অসম্মানিত বোধ করতাম; প্রতিবাদ করতাম। তাই আমার অন্তত অবাক লাগে যে এই অনাস্থা ও অসম্মান আমাদের পুরুষদের আত্মমর্যাদা বোধে কেন আঘাত করেনি! তবে কি এটাই কাম্য ছিল? পুরুষরা কি চিরকাল অনাস্থার পাত্র হয়েই থাকতে চেয়েছে? কখনও আস্থা অর্জনের কোনও চেষ্টাও কি তারা করেছে? নাকি নারীর চোখে ভরসা দেখার চেয়ে ভীতি দেখতেই তারা অধিক উৎসাহী?
শুধু পুরুষ বলে তো কথা নয়, নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই ব্যবস্থা তো আমরা মেনে নিয়েই এসেছি। আরও বীভৎস লাগে কিছু কিছু পরিবারে যখন দেখি নিজের বাবা, ভাইদের সামনেও মেয়েদের ওড়না পরবার প্রচলন রয়েছে। এমনকি গর্ভজাত পুত্রটি ঘরে থাকলেও মা ওড়না ছাড়া থাকে না! আমি তো দূরতম কল্পনায়ও আনতে পারি না যে, এরা নিজের বাবা, ভাই কিংবা পুত্রের দৃষ্টি থেকেও নিজেদের নিরাপদ মনে করে না!!
আমি যদি পুরুষ হতাম আর নিজের মা-বোন-কন্যাকে দেখতাম এইরূপে আমার কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করতে আমি জানি না আমার আর এই গ্রহে বসবাসের রুচি থাকতো কিনা!! অথচ আমাদের নারীরা কালে কালে এই রূপেই নিজেদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের পুরুষরা যে কেবল তা মেনেই নিচ্ছে শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যও করছে। এসব দেখে শুনেও আমরা কিন্তু কেউ বলিনি এটা বিকৃতি!
একবার পুরো শরীর ঢাকার পর দ্বিতীয় দফা বিশেষ একটি স্থানে এক টুকরো আলগা কাপড় লটকে বয়ে বেড়ায় যে জাতি তারা কতটা অসুস্থ মননের অধিকারী সে প্রশ্ন কিন্তু আমরা তুলিনি! বরং আমরা যারা তুলনায় ‘আধুনিক’, তারাও ফ্যাশনের অজুহাতে এই নোংরামিকে বৈধতাই দেয়ার ফন্দি করেছি এতোকাল। আর সেই সুযোগে এই বাড়তি সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি বহাল রেখে শরীরের একটি স্বাভাবিক অঙ্গকে ধীরে ধীরে কী ভীষণ রকম অস্বাভাবিক করে তুলেছি!
আমি বিশ্বাস করি, ওড়না একটি অশ্লীল পেশাক, কেননা এটি নিষিদ্ধতার ইঙ্গিত বহন করে।
অফটপিক: রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা মোটর সাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে মেয়েদের মৃত্যুর খবর নিয়মিতই পাওয়া যায়। ওড়না বিপজ্জনক পোশাকও।