প্রবীর কুমার:
গ্রামের নারীদের সচেতন না করলে নারীবাদ সফল হবে না। কথাটি সবার জানা থাকলেও এর প্রয়োগ কম। তাই পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয় না।
যে দেশের অধিকাংশ নারীর বাস গ্রাম কিংবা মফস্বলে, নারীবাদ সফল করতে তাদের কাছে অধিকার ভোগের সুখ, সম পরিমাণ সম্মান পাওয়ার তৃপ্তি, পুরুষের মতো নিঃসঙ্কোচে পা ফেলার আনন্দ, দাসীবৃত্তি থেকে মুক্তির সুখের কথা জানাতে হবে। তারা আলোকেই আঁধার ভাববে, নিজেকে অন্ধের মতো সপে দেওয়ার মাঝেই স্বার্থকতা দেখবে; তবুও পরিবর্তনের প্রদীপ জ্বেলে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দায় এবং দায়িত্ব আমাদেরই।
পরিবর্তনের হাওয়া লাগা এবং পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সাধারণত শহর থেকেই শুরু হয়। কারণ নতুন কোন বার্তা আসা, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ শহরেই হয়ে থাকে। এখানে মাধ্যম তুলনামূলক আধুনিক। নারীবাদটাও তেমন, নগরকেন্দ্রিক মানুষগুলোর মাঝেই এর প্রভাব দেখা যায়। তাই স্বল্প সুবিধাভোগী এবং স্বল্প স্বপ্নের গ্রামীণ মানুষগুলো স্বাভাবিক কারণেই পিছিয়ে থাকে।
আমরা যারা বিভিন্ন শহরে থাকি তাদের প্রায় সকলেরই শেকড় গ্রামে। সুযোগ পেলেই আমরা সেখানে ছুটে যাই। এখানার মানুষ আর চারপাশটা আমাদের খুব চেনা। তাই এই চেনা পরিবেশে চেনা মানুষগুলোর মাঝে নারীবাদের কথা সহজেই বলতে পারি, তাদের অধিকারের কথা জানাতে পারি। তারা এটাকে হয়তো সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে নেবেনা। কারণ দীর্ঘদিন সংকীর্ণ ভাবনা নিয়ে গুটিয়ে থাকা এক ভিন্ন রকম জীবন কাটিয়েছিয়ে তারা, এমন জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু একটু একটু করে তাদের ভাবনার জগতে ধাক্কা না দিলে তো পরিবর্তন আসবে না।
পরিবর্তনের শুরুটা হতে পারে নিজ পরিবার থেকেই। তারপর পাশের ঘর, পাশের বাড়ি। কিংবা সুবিধামতো যে কারো কাছ থেকে। নিজের জীবন থেকেই দেখেছি নিজ ঘরের মেয়েদের প্রতি বৈষম্য, এরপর বদলে যাওয়া। আমার মায়ের কাছে আমার বোনটির থেকে হয়তো আমিই বেশি পছন্দের ছিলাম। খাবারের সময়ও আমার সন্তুষ্টির কথা বেশি ভাবতেন। তখন ভালো লাগলেও এক সময় তা বড় লজ্জার হয়ে ওঠে। বুঝতে পারি এটা ভুল, লজ্জার। সেই পরিবর্তনটা আমিই এনেছিলাম, যদিও তখন নারীবাদ বুঝতাম না। মায়ের প্রতি বাবার মেজাজ দেখানোরও পরিবর্তন ঘটেছে অনেকটা। আমার অল্প কয়েকটি কথাই এই পরিবর্তনটা এনেছিলো।
সরকার কিংবা বিভিন্ন এনজিও গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য কিংবা মৌলিক অধিকারের কথা বলে নারীদের পরিবর্তন আনতে চায়। ভালো। কিন্তু এতে নারীমুক্তি ঘটেনা। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এই প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের মস্তিষ্কে বাস করা পুরুষতন্ত্র দূর করার কথা বলেনা, সম অধিকার ভোগের কথা বললেও কী করে সম অধিকার ভোগ করা যায় তা বলেনা। তাই পরিবর্তনের ভাবনা আর তার প্রয়োগের দায় আমাদেরই রয়ে যায়। নারীবাদ কতটা প্রয়োজন তা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদেরই রয়ে যায়।
দেশের অধিকাংশ নারী গ্রামে বাস করে বলে শুধু নারীদের পরিবর্তনের কথাই বলছি না। একই রকম করে গ্রামীণ পুরুষদের মাঝেও পরিবর্তন আনতে হবে। তেমনি গ্রামীণ নারীদের পরিবর্তনের কথা বললেও শহরের নারীরা খুব বদলে গেছে তাও বলছিনা। আজ শহরের অনেক নারীই তাদের অধিকারে সচেতন, তবে অধিকাংশ নয়। আবার অনেক পুরুষও নারীদের অধিকারে ইতিবাচক, তবে তার সংখ্যা অতি অল্প।
নারীবাদ শুধু নারীদের নয়, নারী-পুরুষ সকলের। বরং পুরুষদের আরো বেশি এগিয়ে আসা উচিৎ। কারণ তাদের মাথার উপরে পুরুষতন্ত্র নামক যে লজ্জা ঝুলছে তা নিজ উদ্যোগেই সরাতে হবে। নারীবাদের কথা যেমন বলতে হবে তেমনি এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
গ্রামীণ নারীদেরও নারীবাদী করে তোলা এখন সময়ের চাওয়া, সভ্যতার দাবি।