নুসরাত বাবলী:
মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল হওয়াটা খুব জরুরি। আমাদের দেশে মেয়েরা জনম ধরেই পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত বাবা/ভাই আর বিয়ের পর স্বামী। এমন অবস্থাগুলোতে মেয়েরা যখন একটু বড় হয়ে ভালো মন্দ বুঝতে শিখে, তখন সে অনেক সময়ই তার অনেক প্রয়োজনের কথা বাবা/ভাইকে বলতে পারে না। এই ভেবে যে, তারা ব্যাপারটাকে কীভাবে নিবে!
বাবার ক্ষেত্রে এমনটা না ঘটলেও অন্য কারো কাছে নিজের সব প্রয়োজন বা চাহিদার কথা অনেক মেয়েই মুখ ফুটে বলতে পারে না। একই ঘটনা ঘটে বিয়ের পরও। কারো কাছে টাকা চেয়ে নিজের শখ মেটানো অনেক সময় হয়ে ওঠে না। কোনো বিশেষ প্রয়োজনে হাত পেতে টাকা নেওয়া সেও এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। এসব সমস্যা এড়াতে আমার মনে হয়, প্রতিটা মেয়েরই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বিকল্প নেই।
আর সেকারণেই বাবা-মায়ের উচিত পরিবারের ছেলে সন্তানটিকে তার উচ্চশিক্ষার জন্য যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, ঠিক একই সুবিধা যেন পরিবারের মেয়ে সন্তানটিও পায়, তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। অনেক পরিবার আছে, যারা তাদের কন্যা সন্তানকে লেখাপড়া শেখান শুধুমাত্র একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য, এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই।
আবার অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবার আছে, যারা শিক্ষিত বউ ঘরে আনেন শুধুমাত্র “শিক্ষিত বউ” সমাজে এ কথাটা যেন বলতে পারে। কিন্তু এমন কেন হবে! মেয়েরা যদি সুশিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কারো না হলেও অন্তত নিজের প্রয়োজন মিটাতে পারে, তাতে তো দোষের কিছু নেই। যদি হঠাৎ করেই এমন কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতে হয় (বাবা/ভাই/স্বামী), যার জন্য আদৌ আপনি প্রস্তুত ছিলেন না, এমন সময় ঐ মেয়েটির সহযোগিতা হলে আপনার জন্য সবকিছু কিছুটা হলেও সহজ হয়ে যেতে পারে।
আমি এমনও অনেক পরিবার দেখেছি, যারা জেনে-শুনে ঘরে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বউ নিয়ে আসে, এবং বিয়ের পর তাদের জব ছাড়তে বাধ্য করে। অথবা পড়া চলাকালীন বিয়ে হলে মাঝপথেই পড়া বন্ধ করতে বাধ্য করে। এক কথায় যাকে বলে স্বপ্নগুলোর গলা টিপে হত্যা করা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই মেয়েটিকে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। না হলে সংসার টিকানোর আর কোন উপায় থাকে না। কীইবা করবে! বাঙালি মেয়ের কাছে এখনও যে সংসারই প্রধান।
কেনো! আপনাদের মনে যদি এই চিন্তাই ছিলো, তাহলে একজন লেখাপড়া না জানা বা স্বপ্ন না দেখা কোনো মেয়েকে ঘরে আনলেই তো পারতেন! শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে এনে কেন তাকে হত্যার দায় কাঁধে নিলেন? হ্যাঁ, এটিকে আমি হত্যাই বলবো। শুধু মাটির শরীর থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নতাই মৃত্যু নয়। যখন আপনি কারো স্বপ্ন ভাঙলেন তার মানে আপনি একটা হত্যা করলেন। দেহের নয় একটা আত্মার হত্যা, যার সাক্ষী কেউ নেই, লাশটাও যেন গোপনে দাফন দেওয়া হয়েছে বুকের গোরস্থানে। মাঝে মাঝে বাতাসের সাথে সেখান থেকে প্রচণ্ড রকম পঁচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে, কিন্তু আপনি তা কখনোই বুঝবেন না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা সে ক্ষমতা কোনো পুরুষকে দেননি। মেয়েটি তখন বালিশে মুখ গুঁজে চোখের জল লুকিয়ে রাখে। বুকের মধ্যে স্বপ্নগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। কাঁচ ভাঙা শব্দের মতো প্রতিনিয়ত কানে বাজতে থাকে। যার খবর কেউ রাখে না। যদি চোখের জলের কোনো রঙ থাকতো তবে প্রতিটা সকালে বালিশগুলো হাজারো রঙের প্রমাণ রেখে যেত, রাতের গভীরে কাঁচ ভাঙা শব্দ হয়ে স্বপ্ন ভাঙার জানান দিতো। কিন্তু এই ব্যথাগুলো মেয়েরা একাই লুকিয়ে বেঁচে থাকে। জন্ম থেকেই মনে হয় এই যোগ্যতা নিয়েই তাঁর পৃথিবীতে আসা। আর এজন্যই কথায় বলে – “মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না”।
সমস্যা অনেক এখানে এক এক করে লিখতে শুরু করলে হয়তো কালি ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু সমস্যা লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে কিছু সমাধান আমরা চাইলেই পারি _____
মেয়ে সন্তানের বাবার জন্য করণীয়—
বাবা-মায়ের উচিত কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষিত করেই বিয়ে দেওয়া। পড়ার মাঝপথে বিয়ে না দেওয়া। কারণ অনেক সময় চাইলেও বিয়ের পর আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, সময়-সুযোগ থাকে, কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা থাকে না, আবার আর্থিক সচ্ছলতা আছে, কিন্তু সময় হয় না। আবার এমনও দেখা যায় দুটোই আছে, কিন্তু মানসিক দিক থেকে দুর্বলতা থাকে। এখানে মানসিক দুবর্লতা বলতে শ্বশুরালয় এর মানুষগুলোর মানসিক দুর্বলতার কথা বলছি। অনেক সময় শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা প্রস্তুত থাকেন না এসব ব্যাপার মেনে নিতে। তারা বউ এর লেখাপড়া বা চাকরির ব্যাপারটা সহজে নিতে পারেন না। আমি এমনও দেখেছি, বিয়ের পর মেয়ের বাবা মেয়েকে ইউনিভার্সিটি ভর্তি করে বই পর্যন্ত কিনে দিয়েছেন, কিন্তু শ্বশুর বাড়ি থেকে সম্মতি না পাওয়ার কারণে বাবা নিজে গিয়ে তার মেয়ের বইগুলো ফেরত নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
এক্ষেত্রে যে গৎবাঁধা কথাগুলো মেয়ের বাবাকে শুনতে হয়, সেগুলো অনেকটা এমন—
মেয়ে পড়াবেন তো বিয়ে দিয়েছেন ক্যান?
পড়াতে হলে মেয়ে নিয়ে যান ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ধরনের কথা শোনার পর একবার চিন্তা করুন নিজের মেয়ের জন্য কেনা বইগুলো ঐ বাবা যখন ফেরত নিয়ে গিয়েছেন, তখন তাঁর মনের অবস্থাটা কী হয়েছিলো? তাই বাবাদের বলছি, ভুল করবেন না। যদিও মানুষ ভুল করেই ভুলটা বুঝতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে সময় থাকতে সচেতন হোন।
শ্বশুরালয় এর জন্য করণীয়—
আপনারা আগে সিদ্ধান্ত নিন, ছেলের বউ কেন চান? একটা মেয়ে সংসারে আসবে, সবাইকে আপন করে নিবে, এই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে থাকবে, এইজন্য? নাকি আপনার সংসারে একজন কাজের লোকের প্রয়োজন ছিল, তাই ভাতে-কাপড়ে একজন শিক্ষিত গৃহকর্মি রাখতে চান?
যদি প্রথম অপশনটা হয়, তাহলে বিয়ের পর বউ এর লেখাপড়া বা চাকরিতে বাধা না হয়ে উৎসাহ দিন।
আর যদি দ্বিতীয় অপশন হয়, তাহলে প্লিজ এমন কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দিন, যার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো এমন কোনো বড় স্বপ্ন থাকবে না। বার বার আপনাকেও বলতে হবে না, “পড়ার শখ বিয়ে করেছো কেনো? বাবা না পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছে কেনো? ছেলে পড়িয়েছি টাকা খরচ করে, এখন তোমাকে পড়াতে পারবো না”।
আর একটা কথা বাড়ির বউকে কখনোই গৃহকর্মি মনে করবেন না। কারণ আপনার ছেলে নিশ্চয়ই এমন কারও সাথে সংসার করবে না!
একটা মেয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে বাবা সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, সেজন্য কন্যা সন্তানের বাবাদের বলছি, আপনার কন্যাকে নদীর সাথে পরিচয় না করিয়ে তাকে সমুদ্র চেনাতে যাবেন না। এতে করে তাঁর ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মেয়েরা সব পারে, কারণ সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে সে যোগ্যতা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সব পারাকে পারা বলা যায় না। কেউ পারে, কেউ ঝরে যায়। যারা ঝরে যায়, তাঁরাও একটা সময় প্রাণহীন জীবন নিয়ে বাঁচতে শিখে যায়। হুম তারা বেঁচে থাকে জীবিত লাশ হয়ে। এজন্য মেয়ের বাবারা যতটুকু পারবেন মেয়েকে নিজের হাতে গড়বেন, অন্যের হাতে এই গুরু দায়িত্ব দিবেন না। কেননা আপনার কন্যা কেবলমাত্র আপনার কাছেই রাজকন্যা। অন্য কারো কাছে নয়।
মনে রাখবেন, যদি এই রাজকন্যাকে আপনি তার উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দিতে পারেন, তবে কারো সাধ্য নেই তাকে ‘অবহেলার পাত্রী’ বানাতে পারে।