ফারিসা মাহমুদ:
যৌনতা নিয়ে লিখবো এমন ভেবেছিলাম অনেক আগেই। আমি কিনা বেশ অলসই, কত কী করবো ভাবি! আসলে ভাবনাতেই অনেক কাজ করি। ভাবতে যতোটা ভালো লাগে, কাজ করতে ততোটা ভালো লাগে না।
যৌনতা সম্পর্কে নতুন করে আমার বলার কিছুই নেই। এ পৃথিবীর আদিমতম শিল্প। যৌনতা সম্পর্কে স্বভাবতই মানুষ জেনেই যায়। আমি আসলে আলাপ করতে চাই এই সময়, আমার মতো বয়সের নারীর যৌনতা সম্পর্কিত ভাবনা নিয়ে। আমার নিজের ভাবনা।
যারা পড়ছেন চমকে উঠেছেন নিশ্চয়ই। যাবতীয় সব ভাবনার কথা বলা যায়, কিন্তু যৌনতা নিয়ে ভাবনার কথা কেউ কখনো বলে নাকি? আমায় খুব বিচ্ছিরি গালি শুনতে হবে জানি। আবার কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এই মেয়ে তো ভালোই শান্ত লাজুক, ভালো পরিবারের, হঠাৎ কী হলো?
আমার নিজেরও আগে সাহসে কুলাতো না আসলে। কিন্তু যখন আমার বয়স চল্লিশের ঘরে বা চল্লিশ পার হলো, তখন আমি লক্ষ্য করলাম অনেক বিষয়েই আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করেছে। আর নিজের ভিতরে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে শুরু করি।
এইখানে বলে নেই, পুরুষ সাধারণত কম বয়সী মেয়েদের যৌনসঙ্গি হিসাবে পেতে চায়। এর মূল কারণ সম্ভবত কমবয়সী মেয়ের উপরে পুরুষের নিয়ন্ত্রণটা সহজ হয়। একজন পরিণত বয়সের মেয়েই যৌনতা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে এবং এ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়। তখন আবার পুরুষের সমস্যা হয়ে যায়। ভেবে দেখেন, ভায়াগ্রা নামের নীল ট্যাবিলেট কিন্তু পুরুষের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছে। মেয়েদের এমন কিছুর প্রয়োজন হয় না, বা হলেও তা প্রায় শূন্যের ঘরে। তাই এই জিনিস মেয়েদের জন্যে নেইও। অথবা থাকলেও তা এতোই অখ্যাত যে আমি জানি না।
নারী শরীরকে যে পুরুষ এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে, নারী শরীরকে দেখানোর, সাজানোর এতো আয়োজন, চাওয়া কি শরীরে থাকে? না মনে? আমি ছবি আঁকি। যখন ফিগার স্টাডি করতে শুরু করেছি, তখন আমি এই বিষয়টা ভাবতে শুরু করলাম। নারী, পুরুষ উভয়েরই নগ্ন ছবি আঁকতে হয় কম-বেশি সব আর্টিস্টকেই। আমিও এ নিয়ে কাজ করেছি একপাল ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসে। আগে হলে আমি এমন নগ্ন মানুষের শরীরের দিকে তাকাতেই পারতাম না, খুব কম মেয়েই তা পারে। অথচ কাজ করার সময়ে খুব সহজভাবেই তাকাতে পারছি, আঁকতে পারছি, এমনকি মডেলের শরীরের মাপজোকও নিতে পারছি। কারণ কী? কারণ হচ্ছে আমি এই নগ্ন শরীরকে কাজ হিসাবে দেখছি। যদি শরীরে যৌনতা থাকতো, তবে নগ্ন শরীর দেখে নিশ্চয়ই আমি তেমন কিছু অনুভব করতাম!
খুব সহজ একটা কথা বলি। আমরা তো নানাভাবেই অন্যের শরীর স্পর্শ করি, করি না? কখনো বন্ধু, কখনো ভাই, কখনো বাবা, কখনো ছেলে, এমন অনেককেই জড়িয়ে ধরি, বা হাত মেলাই। সেই সব স্পর্শের অনুভুতি আর প্রেমিককে স্পর্শ করার অনুভুতি কি এক? তাহলে শুধু শরীরে কি করে যৌনতা থাকে? আবার দেখবেন, যাকে ভালোবাসেন তার শুধু হাত ধরেই যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, ভালোবাসাহীন সম্পূর্ণ যৌনমিলনেও সেই তৃপ্তি নেই। আর নেই বলেই ভালোবাসাহীন, চাওয়াহীন, জোর করে যৌনমিলন হয় ধর্ষণ।
এবং শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মেয়েই কোন রকম সম্পর্ক ছাড়া, মানে মনের দিক থেকে কাছে না এলে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারে না। পুরুষদের ক্ষেত্রে তার উল্টো, এরা শারীরিক সম্পর্কে যাওয়ার জন্যে মনের সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করে।
এই যে মেয়ে হয়ে যৌনতা নিয়ে আলাপ করতে পারবে না, পুরুষ সঙ্গির সাথে সে কতোটা তৃপ্ত বা তৃপ্ত না হলে সঙ্গি বদলাতেও পারে, এই বিষয় নিয়ে মুখ খোলা যাবে না। পুরুষ যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করতে পারে, নারী পারে না কেন? কে বাধা দেয়? হাজার বছরের সংস্কার বাধা দেয়। ধর্ম বাধা দেয়।
একজন পুরুষ সাহিত্যিক তার কাজে যৌনতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। পুরুষের মানসিকতায় তার সেই স্বাধীনতা আছে। বা একজন পুরুষ আর্টিস্টও নগ্নতা বিষয় করে কাজ করতে পারে। নারী সাহিত্যিক বা আর্টিস্ট তা পারবে না। কোথায় যেন বাধা, অতি সুক্ষ্ম সুতোর টান। অথচ যৌনতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। নারী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশকেই তার কাজের বাইরে রেখে দেয়। যৌনতা নিয়ে নারীমুখ খোলে না, চোখ খোলে না, ভাবনাও খোলে না। ফলে নারী আর শুধু সাহিত্যিক না, শুধু আর্টিস্ট হয় না, সে হয় নারী সাহিত্যিক, নারী আর্টিস্ট।
নারী শরীর ছাড়া পুরুষের শিল্প হয় না, সাহিত্যি হয় না, ব্যবসা বাণিজ্য হয় না, এমনকি ঘুমও হয় না। কিন্তু নারী শরীর বিষয়ে কথা বলতে পারবে না, ভাবতে পারবে না।
আশা করছি একদিন একটা উপন্যাস লিখবো, যেখানে জীবনের সব আবেগ আসবে রঙধনুর মতো। সেই রঙের মধ্যে যৌনতাও থাকবে উজ্জ্বল একটা রঙ হিসেবে।