কাকলী রানী দাস:
খুব ছোটবেলা থেকে একটা বিষয় আমার কাছে খুব পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, আমার চামড়ার রঙ কালো এবং এটা আমাদের চারপাশের মানুষের কাছে মোটেই কাঙ্খিত কিছু নয়। গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আমার বড়বোনের গায়ের রঙ তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা উজ্জ্বল, এবং সে খুবই মায়াকাড়া চেহারার অধিকারী।
তো, দুই বোনের দুই রকম চামড়ার রঙ এবং চেহারার পার্থক্যের কারণে আমার আশপাশের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি কখনই ভুলতে পারতাম না যে, আমার ভবিষ্যত অতি অন্ধকার, আমাকে বিয়ে দেবার জন্য পাত্র খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হবে, আমাকে পার করতে বড় অংকের গাঁটের কড়ি খরচ হবে, এবং আমার দুঃশ্চিন্তায় দুনিয়ার কারোই ঘুম হচ্ছে না।
এইসব ভদ্র(??)লোক এবং নারীগণ প্রায়ই অসভ্যতার চূড়ান্ত করতেন। একটা উদাহরণ দেই – বাসার সবাই মিলে হয়তো কোনো বিয়ে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেছি। আমরা দুই বোন কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় দুজনের জামাকাপড় আর সাজগোজ একই রকম হতো এবং সারাক্ষণই দুইজন পায়ে পায়ে ঘুরতাম। দেখা যেতো, চারপাশে মানুষজন গিজগিজ করছে, এরই মধ্যে কোনো একজন নারী বা পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দুই বোনের মধ্যে বড় বোনের থুতনি নেড়ে দিতে বলতো, এই মেয়েটা এতো মিষ্টি কেন? বলা শেষ করে গাল ছুঁয়ে আদরও করে দিত। বোনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, এইটা তোমার বোন? ও এমন কেন?
ঐ অসভ্য মানুষটির দিকে সৌজন্য হাসি মেখে তাকিয়ে থাকা আমি দপ করে নিভে যেতাম। আমার অপ্রস্তুত বোন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতো। তবে যদি আমার মা আশেপাশে থাকতো, তবে এই নারী বা পুরুষের খবর ছিল। ছুটে এসে মা-পাখির মতো ডানার নিচে দুই বোনকে নিয়ে উত্তর দিত, আমার বড়মেয়ের চেয়েও ছোট মেয়ে বেশি মিষ্টি এবং এরপর আমার নাক, চোখ, ঠোঁট কোনটা কতো ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে অতি মনোহরভাবে অবস্থান করছে, তার বর্ণনা দিতেন এবং সাথে সাথে শুরু হতো আমি কোন কাজ কতো মনোযোগের সাথে নিখুঁতভাবে করতে পারি তার লম্বা লিস্ট। এরপরও যদি তারা আরো কোনো অসভ্যতা করার চেষ্টা করতো আমার মা সোজা সাপটা উত্তর দিতো, `আমার মেয়েকে নিয়ে আপনাদের এতো ভাবতে হবে না, আমি আছি ওর কথা ভাবার জন্য`।
কিন্তু মা তো আর সবসময় আমার সাথে থাকতে পারতেন না। রাস্তাঘাটে বেরুলে পেছন থেকে মা কালী ডাক ছিল ডালভাত। আবার অনেক সময় আমার বাবার বয়সী কেউ কেউ হাত জোড় করে ‘মা কালী, রক্ষা করো মা’ বলে সামনে দাঁড়াতো। একটা বয়স পর্যন্ত মন খারাপ করতাম, কিন্তু একটু বু্দ্ধি হবার পর থেকে আমিও উত্তর দিতাম, ‘মা কালীকে হাত জোড় করে কিসের প্রণাম রে, পা ছুঁয়ে প্রণাম কর`। হা হা হা তখন সামনের মানুষটা চেহারা হতো দেখার মতো।
ঢাকা শহরে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে প্রতিবেশি এবং পরিচিত মানুষদের এই আচরণ হয়তো আস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কারণ এখানে কেউ কারো খবর রাখে না, বা কেই কারো ব্যাপারে নাকও গলায় না। তবে আমার ছোট্ট শহরের মানুষগুলো পরস্পরের গলা জড়াজড়ি করে বাস করতো। একে অন্যের সুখে-দুঃখে যেমন প্রাণপাত করে দিতে পারতো, তেমনি স্বার্থে একটু সামান্য আঘাত লাগলেই তাদের অতি কুৎসিত চেহারা দেখাতেও পিছপা হতো না। সেই সাথে এরা একে অন্যের অতি ব্যক্তিগত ব্যাপারে অতি বাজেভাবে নাক গলাতো। এদের অনেকেই যেমন আমাকে অনেক ভালবাসতেন, আবার অনেকের অযাচিত আচরণ আমাকে প্রায় মেরেও ফেলতো।
বর্ণবাদী আচরণের শিকার আমি শুধু পরিবারের বাইরেই হতাম না, বরং বেশি হতাম পরিবারের মধ্যে, তবে এর ধরন ছিল ভিন্ন।
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমার ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাইরে পরার সব জামা ছিল সাদা আর গোলাপী রঙের। এই দুইটা রঙে গায়ের চামড়া কিছুটা কম কালো দেখা যায় বলে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল। তাই আমার জন্য এই দুই রঙের জামাই কেনা হতো। পরে এমন হয়েছে যে, আমাকেও যদি পছন্দ করতে বলা হতো, আমিও এই দুই রঙের জামাই বেছে নিতাম। আমার খুব ইচ্ছে করতো অন্য রঙের জামা পরতে, কিন্তু আমি জানতাম শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে শুনিয়ে এবং না পারলে ধমক দিয়ে হলেও আমার জন্য সাদা আর গোলাপী জামাই কেনা হবে, তাই আর ঝামেলা করতাম না। এমনও হতো বাইরে যাবার জন্য সব ভাইবোন রেডি হয়েছি, আমার বাবা সবাইকে এক ঝলক দেখে আমাকে বলতেন,`এইটা কী জামা পরছিস, যা আরেকটা সুন্দর জামা পরে আয়`। আমি জামা পাল্টাতে যেতাম, আর মনে মনে বলতাম, `জামার কী দোষ, হ্যাঙ্গারটাই তো আপনাদের পছন্দ না, যত সুন্দর জামাই পরি, পছন্দ হবে না`।
না, এতে আমার মন খারাপ হতো না, তবে বাইরে বেড়াতে যাবার ইচ্ছেটাই মরে যেত। কিশোরী বেলায় যেই সময়টায় আমার বয়সী মেয়েরা সারাক্ষণ ঝলমল করতে করতে বেড়াতে যাবার বায়না ধরতো, সেই সময়টায় আমি গল্পের বই হাতে ঘরের কোণে মুখ লুকোবার জায়গা খুঁজতাম।
যখন আমার মা-বাবা তাদের বড় মেয়ের জামাকাপড় আর সাজগোজের অনুষঙ্গের বায়না শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যেত, তখন আমি নিজেকে আরো গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত, নিজেকে সবার থেকে লুকাতে লুকাতে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে পর্যন্ত আমি ভয়াবহ রকমের অসামাজিক ছিলাম, কারো দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারতাম না। মনে হতো সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে, এই মেয়েটা দেখতে এতো পচা কেন? অথচ আমি জানতাম দেখতে আমি মোটেই পচা নই। তারপরও আমার চারপাশের বর্ণবাদী পৃথিবী আমাকে প্রায় বিশ্বাস করিয়েই ফেলেছিল যে আমি দেখতে সুন্দর নই, আমি সবার কাছে আর দশজনের মতো কাঙ্খিত নই। একটা শিশু, কিশোরী বা তরুণীর আত্মবিশ্বাস ধূলোয় মিশিয়ে দিতে এর চেয়ে আর বেশি কিছুর কি দরকার আছে??
সুখের বিষয় এই পর্যায়ে এসে এই কালো অধ্যায়ের শেষ হয়েছে। না, আমার চারপাশের বর্ণবাদী মানুষগুলো ধোঁয়া তুলসীপাতা হয়ে যাননি, তারা তাদের মতোই আছেন, বরং তারা সংখ্যায় আরো কয়েকগুণ বেড়ে আমার শ্বশুরবাড়ি, তাদের আত্মীয়স্বজন, আমার অফিস, রাস্তাঘাট, শপিং মল, ব্যাংক, হাসপাতালসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু আমি নিজেকে পাল্টে ফেলেছি, কারও কোনো নেতিবাচক কথাই আর আমার কাছে আসতে পারে না, আমার কাছে আসার আগেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পালিয়ে যায়। আর হ্যাঁ, আমি এখন হৃদকম্প বন্ধ হবার মতো পৃথিবীর সমস্ত চকচকে ঝকঝকে রঙসহ সব রঙের পোষাক পরি, আর নিজের রূপে নিজেই মোহিত হয়ে যাই। আমি জানি জীবনের কাছে আমি কী চাই, কতটুকু চাই, কীভাবে চাই! প্রতিদিন ঠিক সেইভাবেই আমি দিন শুরু করি, নিজেকে তৈরি করি। আমি জানি কোথায় থামতে হয়, কতক্ষণের জন্য থামতে হয়। আমার আত্মবিশ্বাস সারাক্ষণ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে।
কিন্তু তারপর কোথাও কোনো কালো চামড়ার শিশু, কিশোর/কিশোরী দেখলেই আমার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। মনে হয় আমার মেয়েবেলার মতো এদেরকেও, মানুষজন হা হা করে ছুটে এসে হাতের কনুই বা ঘাড় ঘষতে ঘষতে প্রশ্ন করে নাতো, তুমি প্রতিদিন গোসল করো না? ঠাট্টাচ্ছ্বলে বা খেলাচ্ছ্বলে তার চামড়ার রঙ নিয়ে কোনো কটু মন্তব্য করে না তো? এদের একটা ছোট্ট কথা বা মন্তব্য এই শিশু, কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীকে বাকি জীবনের জন্য ঘরবন্দী করে ফেলবে না তো? কিংবা তার আত্মবিশ্বাসের উপর অবিশ্বাসের প্রলেপ পড়বে না তো?
আজও আমি এর উত্তর খুঁজে চলি……