কামরুন নাহার (রুমা):
যখন ক্লাস থ্রি’র ছাত্রী, তখন প্রথম এক হিন্দু বান্ধবীর বাসায় লক্ষ্মী পূজার দাওয়াত খেতে যাই। আমাদের বাইরে বসতে দেয়া হয়েছিল সেদিন। তার কারণ ওদের একটাই ঘর, এবং সেটা অনেক বড়। পূজার জন্য হিন্দু বাড়িগুলোতে আমি আলাদা ঘর দেখেছি ছোটবেলায়। ওদের যেহেতু একটাই ঘর ছিল, তাই ওটা একই সাথে ওদের পূজার ঘরও ছিল, আর তাই ঘরে একটা প্রতিমা রাখা ছিল সব সময়ের জন্য। আমাদের সেই ঘরে বসতে দেয়া হয়নি, কারণ যে ঘরে প্রতিমা থাকে, সে ঘরে মুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ। মুসলিমরা ঢুকলে পূজা হয় না।
আমি কিছুই মনে করিনি তাতে। শুধু মনে হয়েছে ‘যার যার ধর্ম’ নিয়ম থাকতেই পারে, এতে কষ্ট পাবার কিছু নাই (আমি ছোটবেলা থেকেই বেশি বুঝি)। আরও মজার ব্যাপার অপেক্ষা করছিল তখনও। আমাদের বলা হয়েছিল, খাবার যাতে নষ্ট না করি, কারণ নষ্ট খাবারগুলো ঘরে ফেরত নেয়া হবে না। আসলেও তাই হয়েছিল, আমাদের উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো ফেলে দেয়া হয়েছিল আমাদের সামনেই। আমি অবাক হয়েছিলাম, কষ্ট পাইনি। কষ্ট পাইনি, কারণ মনে হয়েছিল ‘যার যার ধর্ম’।
এই বান্ধবীর বাড়ি আমি যাই আরেকদিন, অনেক বছর পর। আমি তখন সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম এক প্যাকেট কলম নিয়ে, কারণ সামনে ওর বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা ছিল। ততদিনে ওদের ঘরে আরও কামরা বেড়েছে। কিন্তু ও আমায় বেছে বেছে সেই ঘরে নিয়ে বসায় যে ঘরে প্রতিমা আছে। আমি তো অবাক, বললাম ‘তুই এটা কী করলি? আমি তো মুসলিম, ওই ঘরে তো তোদের ঠাকুর আছে’।
ও বলেছিল, ‘আগে জীবন, পরে ধর্ম’। ঠিক যে ব্যাপারটা আমি ক্লাস থ্রিতে পড়াকালীন বুঝেছিলাম, সেটা বুঝতে ওর সম্মান প্রথম বর্ষের শেষ অব্দি পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
আর একটা গল্প বলি।
এক কুরবানি ঈদে এক হিন্দু বান্ধবী এলো দুপুরে। তখন আমরা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। গরু জবাই শেষে মাংস ডাইনিং রুমে এনে রাখা হয়েছে কেবল তখন। ওকে দুপুরের খাবার দিয়ে বললাম, ‘তুই বেডরুমে চল খাবার নিয়ে, এখানে গরুর মাংস আছে’।
ও বলেছিল, ‘গরুর মাংস আছে তো কী হয়েছে, আমার কোনো সমস্যা নাই, আমি এখানেই খেতে পারবো’। ও ওখানে বসেই আরাম করে খেয়েছিল, এমনকি বসে বসে মাংস ভাগ করাও দেখেছিল। আমার প্রথম বান্ধবী আর দ্বিতীয় বান্ধবীর মধ্যে পারিবারিক প্রেক্ষাপটের একটা পার্থক্য ছিল। প্রথম বান্ধবীর পরিবারের সবাই শিক্ষিত ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় বান্ধবীর পরিবারের সবাই ছিল শিক্ষিত এবং বেশ উদার। (ধর্মীয় উদারতার জন্য শিক্ষা জরুরি নয়, এটা আমার বিশ্বাস)।
কিছুদিন আগে আমার এক হিন্দু ছাত্র বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কীরে, কেমন বেড়ালি’? ও মন খারাপ করে উত্তর দিয়েছিল ‘ভালো না’। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কেন’। ও বলেছিল, ‘ম্যাডাম, আমি তো হিন্দু, আর ওরা মুসলিম, তাই ওর মা-বাবা আমার সাথে খুব অদ্ভুত আচরণ করেছেন, যেন আমি অচ্ছুৎ’। খারাপ আচরণ বলতে ও যেহেতু হিন্দু তাই ওকে বসতে দেয়া, খেতে দেয়া, শুতে দেয়া সবকিছুতে ওনাদের এক ধরনের তাচ্ছিল্য ছিল। ‘আমার সাথে হিন্দু শোনার পর ঠিকমতো কথাও বলেনি ওরা ‘ – বলেছিল আমার ছাত্রটা। আমি অবাক হইনি, কষ্টও পাইনি।
উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত ‘হিন্দু শিক্ষার্থীটির চোখের দিকে তাকাতে আমার লজ্জা হয়’ শিরোনামে লেখাটির পাঠক ১,৬৬,৯৭৭ এবং লেখাটি শেয়ার করেছেন ২৭ হাজার ২০০ জন। লেখাটিতে মতামত দিয়েছেন ১৪৩ জন, যেখানে মুসলিমদের উপস্থিতি খুবই কম। যে কজন মুসলিম মতামত দিয়েছেন, তারা আমাকে নাস্তিক বলে গালি দিয়েছেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এন্তার প্রশংসা করেছেন।
অনেকে বলেছেন, আপনি হিন্দুদের পক্ষে লিখেছেন, তাই হিন্দুরা আপনাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। আমি একটা বিষয় ভেবে পাই না, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যারা আমার লেখা পড়েছেন, লেখায় মতামত দিয়েছেন, তারা সবাই শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এই সাধারণ জিনিসটা কেন বুঝতে পারছে না যে, এই লেখাটা কোনো ধর্মের পক্ষের বা বিপক্ষের লেখা নয়। এটা ধর্মকে ঢাল বানানো কতিপয় মানুষের নোংরামি নিয়ে লেখা, যা আমি স্পষ্টই উল্লেখ করেছি।
উপরে যে তিনটি উদাহরণ ব্যবহার করলাম সেখানে একই হিন্দু ধর্মের মানুষের ভিন্ন রকম আচরণ এর উল্লেখ আছে। আবার একটা মুসলিম পরিবারেরও একজন হিন্দু ছেলের সাথে খারাপ আচরণের গল্পটাও আছে। উদার বা গোঁড়া সব ধর্মেই আছে, থাকবেও। গোঁড়াদের সংখ্যা কম, উদাররাই সংখ্যায় বেশি।
এইদেশে যেহেতু মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই পান থেকে চুন খসলেও দায়টা মুসলিমদেরই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পান থেকে চুন খসানোর কাজটা কখনই আম জনতা করে না, করে ক্ষমতাধররা, আর তাদের সেই ক্ষমতার বলি হই আমরা সাধারণ মুসলিমরা, গালিও খাই আমার মতো একজন সাধারণ মানুষই।
একজন খুব নিরপেক্ষ মানুষের জায়গা থেকে বলি, এই দেশে শুধু মন্দিরের পুরোহিত নন, মসজিদের ইমামও নিষ্ঠুরভাবে খুন হোন। তখন কাউকেই সরব দেখি না সেই হত্যার বিচার চেয়ে। এই দেশে শুধু মুসলিমরাই নয়, অনেক বড় বড় পদে অনেক সংখ্যায় হিন্দু ব্যক্তিরাও আছেন।
এইদেশে সংখ্যালঘু বলে নিয়ত মুসলিমরা অত্যাচার করে, এই সেট মাইন্ড নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এই দেশ যতোটা মুসলিমের, ততোটাই হিন্দুর। গুটিকয়েক মানুষের জন্য পুরো মুসলিম সমাজকে গালমন্দ করাটা অশোভন।
সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট