সাবিহা শবনম:
বিয়ের আগে আমরা বন্ধু-বান্ধবী একসাথে আড্ডা দিতাম। চায়ের ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসতো নানান ইস্যু। ঘন্টার পর ঘন্টা তর্কে বিতর্কে কেটে যেতো টেরই পেতাম না। হলেও আড্ডা চলতো রাতে খাবারের পর। সারারাত আড্ডা দিয়ে সকালে ক্লাসে যেতাম। তারপরেও কোনো ক্লান্তি ভর করতো না।
বিয়ের পর বন্ধুবান্ধব বদলে গেল, বরের বন্ধুরা নতুন বন্ধু হলো। আড্ডার ধরন বদলালো। বর অবশ্য আমাকে সাথে নিয়েই আড্ডা দিতে যেত। কিন্তু আমার সেই নতুন পরিচিত বন্ধুদের সাথে ঠিক জমতো না। কিছুক্ষণ পরেই খারাপ লাগা শুরু হতো। আমার বরের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই অপরিবর্তনীয় আড্ডা- অবাক হয়ে দেখতাম আর আমার প্রিয়মুখগুলির জন্য বুকের মধ্যে মোচড় দিত।
আহা!! এমন দিন আমারো ছিল!!
বরের বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় হবার আগেই নিজের দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে বন্ধু পাতালাম। এখানে ভিন্ন নিয়ম।পুরুষেরা আলাদা আড্ডা দিবে এবং মেয়েরা আলাদা (আড্ডা বলা যায় কিনা জানি না, কারণ তারা অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি নেয়)- অন্দরমহলে। অপরিচিত, স্বল্পপরিচিত যেই হোক না কেন, একই নিয়ম। ছেলেরা কেন মেয়েদের সাথে অন্দরমহলে আড্ডা দিবে? অথবা মেয়েরা! যতই প্রগতিশীল ছেলে হোক না কেন, পুরুষ তো! যেন সারা পৃথিবীতে যা ঘটে চলেছে, মানুষের আবেগ অনুভূতি, হাসি তামাশা সবকিছুই পুরুষ এবং নারীর জন্য ভিন্ন। আড্ডাও ভিন্ন!!
প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম। নিজেকে সারাক্ষণ ভ্যাবাচেকা খাওয়া মনে হতো। পরের দিকে বিরক্ত হতাম।
আমার নতুন যারা বন্ধু হলো তারা সবাই মা। আমাদের সমাজে একজন মায়ের আড্ডাবাজ হওয়া শুধু অনৈতিকই না, পাপ! একজন বাবার এককভাবে আড্ডাবাজ হওয়া সমাজাদৃত এবং প্রশংসিত। মায়েরা সারাদিন নিজের কাজ, বরের কাজ, সন্তানের কাজ সেরে সারাক্ষণ নিজের বিশ্রামের সুযোগের কথা ভাবে। সেটা আমাদের সমাজে একজন মায়ের একক সংগ্রাম। এই শারীরিক এবং মানসিক সংগ্রামের যৌথায়ন আমাদের সমাজে পাপসমতুল্য। তাই ২৪/৭ এই রুটিনের মৌন সমব্যথীও কেউ হয় না। এই মায়েদের জন্য সেজন্যেই আড্ডা হয়ে ওঠে বিরক্তিকর।
আমি মা হবার আগে কল্পনায় এই যৎসামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। মা হবার পরে দেখলাম এর আরো ভয়াবহ বাস্তবতা। সন্তানকেন্দ্রিক চিন্তায় একজন মা সবসময় আবিষ্ট থাকে। নিজের সব ভুলে সন্তানের খাওয়া, ঘুমও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ পর্যায়ক্রমিকভাবে মাথার মধ্যে লেপ্টে থাকে। এই অবস্থায় কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় সময় কাটানোকে সময় অপচয়ই মনে হয় (কেননা এই সময়ের কাজগুলো অন্য কেউ করে দেয় না) আড্ডা তো পরের প্রশ্ন।
নারী সংসারের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিজের স্বপ্ন, ভালোলাগা বিয়োগ করে পুরোপুরিভাবে সংসারে যুক্ত হয়। কেননা এর বিকল্প হিসেবে কোনো পুরুষই হাল ধরে না। এখন অতিরিক্ত বুদ্ধিজীবী পুরুষেরা প্রশ্ন করতেই পারে মায়েরা কেন এই ট্যাবু থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না? কেন?
এইসব অন্ধ পুরুষদের বলতে চাই আপনারা কি কখনো এই ট্যাবু ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টার কথা কল্পনা করেছেন নিজেরা সংসারের দায়িত্বে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে!! কখনো কি মাকে, বোনকে অথবা বৌকে বলতে পারবেন – আজ পুরোটা সংসার আমি সামলাচ্ছি, তোমরা বন্ধুর সাথে সময় কাটাও। অসম্ভব!!! বরং সমসাময়িক যেসব পুরুষ একটু মুক্ত চিন্তা শুরু করেছে তাদেরকে বিভিন্ন নোংরা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। কিন্তু আমি জানি, একজন পুরুষের সকালে পরিষ্কার তোয়ালে থেকে শুরু করে রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত টান টান বিছানা, মশারী টাঙ্গানো, এমনকি বাতি নেভানো পর্যন্ত নারীর সাহায্যকে আবশ্যিক পাওনা মনে করে। এতে তিল পরিমাণ লজ্জাবোধ নেই তাদের। কবে এই অকর্মণ্য পুরুষগুলো নিজের এই পঙ্গুত্বকে লজ্জা হিসেবে বুঝতে শিখবে কে জানে!!
যেসব বাবারা মায়েদেরকে অস্বস্তিকর অবস্থায় রেখে নিজেরা স্বস্তিকর আড্ডায় মেতে ওঠেন, তাদের ভুলেও মনে হয় না একজন মায়ের মানসিক প্রফুল্লতার প্রয়োজন বেশি এবং আড্ডাতে সে অগ্রগণ্য। তাকে সে সুযোগ দেওয়া উচিৎ। বাচ্চা সামলাবার দায়িত্ব মায়ের একার নয়। বরং আপনারা উপহাসের সাথে ঘোষণা করেন মেয়েরা আড্ডা দেওয়ার যোগ্য না।পুরুষদের এই অপোক্ত চিন্তা নারীদের মনে তাদের জন্য করুণার জন্ম দেয়। আর কিছুই না।
সম্প্রতি নারী আড্ডা নিয়ে কিছু লেখা আর ফেসবুক পোস্ট দেখে আবেশিত হয়েছি। মনে মনে এবং আজ প্রকাশ্যে বলছি- সমাজের এই ট্যাবু পুরুষদের ভাঙ্গা উচিৎ; নারীদের নয়। আড্ডা নারী-পুরুষের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে লিঙ্গবৈষম্য যদি আমরা সৃষ্টি করি, সেটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক বৈকি!!!