মুনিবা মাযারী: একটি সাহসী, দৃপ্ত এবং দৃঢ়তার গল্প

রিফাত ফারজানা ফারিহা:

দেখতে অসাধারণ একজন সুন্দরী নারী হুইল চেয়ারে বসে দৃঢ় কন্ঠে নিজের জীবনের গল্প বলে যাচ্ছেন, শত শত উৎসুক দর্শক-শ্রোতা অবাক চোখে তাকে দেখছে। দেখার মতোই দৃশ্য! পাকিস্তানের ভীষণ রক্ষণশীল ‘’বালুচ’’ পরিবারে জন্ম আর বেড়ে ওঠার অতি সাধারণ ফলাফল, নারী হিসেবে নিজের ইচ্ছা- স্বপ্ন সবকিছুতে পানি ঢেলে পরিবারের ইচ্ছায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে, অত:পর সংসার।

নাম তার মুনিবা। সংসারের কঠিন বাস্তবতা আর ব্যস্ততায় নিজের স্বপ্নগুলো প্রায় ভুলতে বসা মুনিবা একদিন স্বামীর সাথে নিজের শহরে যাচ্ছিলেন, গাড়ি চালাচ্ছিলেন মুনিবার স্বামী নিজেই এবং ড্রাইভিং এর এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি…ফলাফল, সড়ক দুর্ঘটনা।

মুনিবা’র স্বামী এক প্রকার নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে স্ত্রীকে ফেলেই গাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে সক্ষম হলেন, কিন্তু মুনিবার কী হলো? নাহ, মেয়েটা মারা যায়নি। শরীরের অর্ধেক অংশ প্যারালাইজড, মেরুদণ্ড আর শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের হারগুলো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে এই আর কী! তার ডান হাতের কব্জি, গলার এবং কাঁধের হাড়গুলো ফেটে গেছে। মেরুদণ্ড আর পশ্চাতের অস্থিমজ্জাগুলো খুব বাজে ভাবে ফেটে যাওয়ায় সে আর কোনদিন দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারবে না। এতোগুলো দুঃসংবাদও যথেষ্ট ছিলো না।

সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ ছিলো, মুনিবা আর কোনদিন মা হতে পারবেন না। সেইদিন তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন, প্রথমবারের মতো, সেদিন তার মনে হয়েছিলো কেন বেঁচে আছে সে? মারা গেলেই তো বেশ ছিলো…মুনিবা ছবি আঁকতেন, ডাক্তার এও বলেছিলেন যে, তিনি আর কখনও ছবি আঁকতে পারবেন না।
সবকিছু যখন অসহনীয়, তখন একদিন ভাইকে অনুরোধ করে কিছু রঙ আর ক্যানভাস আনালেন, আর সেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তার প্রথম পেইন্টিং! সবার ভীষণ প্রশংসা, কত রঙের মিলনমেলা সেই ক্যানভাসে! কিন্তু রঙের ভেতর লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ কেউ দেখতে পায়নি। টানা আড়াই মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকে
দৃশ্যপটে কিছুটা পরিবর্তন আসে তা হলো শয্যা বদল! হাসপাতালের শয্যা থেকে নিজের বাড়ির শয্যা!

চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ একমাস নয়, দুই মাস নয়, ছয়মাস নয়…দুই বছর তাকে এভাবে বিছানায় শায়িত থাকতে হবে। শরীরে তিনটি মেজর এবং দুইটি মাইনর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অসংখ্য মেটাল সংযুক্ত করা হয়, যা হয়তো আক্ষরিকভাবে তাকে ‘লৌহমানবী’ তে রুপান্তর করে, কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে,এলারজি, আলসার এবং বিভিন্ন ইনফেকশন তাকে কামরাবদ্ধ করে দেয়। আরো কিছু ক্ষত যোগ করতে ভূমিকা রাখতে শুরু করলো পারিপার্শ্বিকতা-তখন যেন মুনিবার শারীরিক ক্ষত’র চাইতে মনের ক্ষতই বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। অতঃপর সেইদিনটি এলো, যেদিন শয্যা ছেড়ে হুইল চেয়ারের জীবন শুরু হলো। দিনটা মুনিবা’র পুনর্জন্ম ছাড়া কম কিছু ছিলো না।

সেইদিন মুনিবা আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে নিজে কিছু শপথ করেছিলেন- নিজেকে নিজের অবলম্বন হওয়ার শপথ, নিজের শারীরিক অক্ষমতাগুলোকে ছাপিয়ে পৃথিবীর বুকে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির শপথ, নতুন করে বাঁচতে শেখার শপথ, অন্যদের অনুপ্রেরণা দেয়ার শপথ।

মুনিবা ভুলে যায়নি, তার দুঃসময় জুড়ে পাশে থাকা বা দূরে সরে যাওয়া মানুষদের। যাদের অনুপ্রেরণা হয়তো খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো তারা অনেকেই দূরে সরে গেছে কিংবা পাশে থেকেও বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মুনিবার অক্ষমতাগুলোকে। কিন্তু মুনিবার মা সবসময় পাশে ছিলো, মা বলেই হয়তো জানতেন, সৃষ্টিকর্তা তার সন্তানের মঙ্গলের বাইরে কিছুই করছেন না। সেই সাহসেই মুনিবা উঠে দাঁড়াতে শিখলেন, হয়তো নিজের পায়ে নয়, তবে নিজের প্রতিভা আর যোগ্যতাবলে।

মুনিবা একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ঘুরে দাঁড়াবার, নিজের সব ভয় আর দুর্বলতাগুলোকে জয় করবার। কাগজে একে একে লিখে ফেললেন নিজের ভয় আর দুর্বলতার জায়গাগুলো। যেটার প্রথমেই ছিলো, ডিভোর্স ! মুনিবা উপলব্ধি করলেন, যে মানুষটাকে তার কঠিন সময়ে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ছিলো, সে মানুষটা সেখানে উহ্য ছিলো। তাছাড়াও পিতৃত্বের স্বাদ থেকে স্বামীকে বঞ্চিত করতে চাননি তাই তাকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত।

কিন্তু মা হবার তৃষ্ণা তাকে ভীষণভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সন্তান দত্তক নেবার। বিভিন্ন অনাথ আশ্রম ও সংস্থায় নিজের নাম দিতে থাকলেন এবং অবশেষে প্রায় দুই বছর অপেক্ষার পর একটা সংস্থা থেকে মাত্র দুই দিনের একটা ছেলে শিশুকে দত্তক নিতে সক্ষম হলেন। আজকে তার সন্তানের বয়স ছয় বছর, তিনি জন্মসূত্রে না হলেও সত্যিকার মা হতে পেরেছেন বটে!

এরপরে তিনি বিভিন্ন কর্মসংস্থানে জীবিকার সন্ধান করছিলেন এবং পাকিস্তানের প্রথম অফিশিয়াল ওয়েবসাইট heartofasia.pk তে একজন কন্টেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পেইন্টিং এ আরো মনোনিবেশ করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তার আঁকা চিত্র প্রদর্শনী হতে থাকে। ‘Let your walls wear colors’ অর্থাৎ ‘তোমার দেয়াল রাঙাতে দাও রঙে’ এমন একটি শ্লোগানে নিজের ব্র্যান্ড ‘Muniba’s Canvas’ প্রতিষ্ঠা করেন।

তবুও তিনি আত্মতৃপ্তিহীনতায় ভুগছিলেন। তিনি অনুভব করলেন, সমাজ এবং জাতির জন্য তার অনেক কিছু করার আছে। তাকে মানবকল্যাণে অবদান রাখতেই হবে, তবেই হয়তো তার আত্মতৃপ্তির দেখা মিলবে। সেই মতো কাজ শুরুও করলেন, দরিদ্র আর অধিকার বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বর্তমানে মুনিবা UN Women Pakistan জাতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে এবং বিভিন্ন অনুপ্রেরণাকারী স্পিকার হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এছাড়াও TEDx ইসলামাবাদ এবং বিবিসি ‘র ১০০জন অনুপ্রেরণাকারি নারী, ২০১৫ তালিকায় স্থান পাওয়া অন্যতম একজন পাকিস্তানি।

পাশাপাশি পিটিভি (পাকিস্তানি টিভি) তে উপস্থাপনার কাজ করছেন, যেখানে মুনিবাই একমাত্র হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী উপস্থাপিকা। Tony & Guy নামে বিশ্ববিখ্যাত চুলপ্রসাধনী একটা ব্র্যান্ডের জন্য প্রথম হুইল চেয়ার মডেলের ভূমিকাতেও কাজ করেন তিনি। TEDx সহ আরো কিছু সংস্থা, যেমন, অন্টোপ্রনিওর’স অর্গানাইজেশন, ইয়াং প্রেসিডেন্ট’স অর্গানাইজেশন, ইয়ুথ অন্টোপ্রনিওর অর্গানাইজেশন, গ্লোবাল লিডারশিপ কনফারেন্স ২০১৬, ভিকন মালয়েশিয়া ২০১৭, ভিকন দুবাই ২০১৭, লিডারশিপ সামিট পাকিস্তান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে প্রণোদনাকারী বক্তব্য দিয়েছেন।

একজন মুমূর্ষু রোগী, যার কিনা জীবনটাই বিপন্ন ছিলো। চিকিৎসকের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যার হাতে কোনদিনই কলম বা রংতুলি ওঠার কথা নয়, বাঁচা-মরার লড়াইতে যাকে মূল্য দিতে হয়েছে অনেকটার চাইতেও বেশি…

একজন নারী, যিনি কিনা অন্য একজনের অসাবধানতার মাশুল দিতে নিজের মাতৃত্ব ক্ষমতা হারালেন, শরীরের অর্ধেকটাই হলো অচল! অথচ স্বামীকে পিতৃত্ব আর অধিপতির আধিপত্য থেকে বঞ্চিত না করার স্বার্থে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন…।

একজন মানুষ, যিনি আজ শুধু নিজের জীবন নয়, আরো অনেকের জীবনে আলো আনার চেষ্টায় প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন।নিজের অক্ষমতাগুলোকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা আর ইচ্ছাশক্তির কষ্টিপাথরে ঘষে মেজে শক্তিতে রুপান্তরিত করে চলেছেন, তিনি একজন মুনিবা মাযারী! একজন সৈনিক ,যিনি শুধু জীবন যুদ্ধে নয়, নিজের সাথে নিজের মানসিক যুদ্ধেই জয়ী হতে পেরেছেন।

সকল প্রতিবন্ধকতাকে পরাজিত করে আজ তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। শুধু একজন নারী বলে নয়, একজন মানুষের জীবনে ‘স্বেচ্ছাশক্তি’র জোর আর অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে অনেক বেশি আর সেই শক্তির জ্বালানী দেয় ‘ইতিবাচক চিন্তাবোধ’ , যা কিনা মুনিবা কে তার সকল বাঁধা পেরোতে টনিকের মতো সাহায্য করেছে। আজ সত্যিই তিনি একজন অপরাজিতা! 

Source: https://www.youtube.com/watch?v=RF553vxCbcU
https://www.youtube.com/watch?v=I68Y81ZpjNM&t=306s
https://en.wikipedia.org/wiki/Muniba_Mazari

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.