নতুন সৌন্দর্যকে অপমানের অধিকার কারও নেই

ফারজানা নীলা:

কিছুদিন আগেও আমি সরল ছিলাম। ছিলাম নিষ্পাপ। ছিলাম ঝিরঝির বাতাসের মতো। ইচ্ছের অধীন আমি যখন যা খুশি করতে পারতাম। ইচ্ছে হলেই দৌড়াতে পারতাম। উড়তে পারতাম। হঠাৎ হোঁচটও খেতাম। হাউমাউ করে কাঁদতাম। মা এসে আমাকে শান্ত করতো। বাবা এসে মলম লাগাতো।

এখন কেন আমি দৌড়াতে পারি না? হোঁচটও খাই না। মাকে ছুটে আসতে দেখি না। বাবাকে “আহ, আবার ব্যথা পেয়েছে” বলতে শুনি না!

আমি টের পাই আমার ভেতরে কিছু ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে। ভয়ে কুঁকড়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে আমি বিমর্ষ হয়ে থাকি। মাঝে মাঝে এখন লজ্জা পাই। সেদিনও আমি শুধুমাত্র একটি ছোট জামা আর প্যান্ট পরে “বৌছি” খেলেছি। আমার লজ্জা লাগেনি। কেউ আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়নি। আজ তাকিয়েছে। আমার গলার নিচের দিকে কেউ একজন বার বার ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমি নিশ্চল হয়ে গিয়েছিলাম সেই দৃষ্টিতে। বাসার দারোয়ান। যাকে আমি আঙ্কেল ডাকি। যে মাঝে মাঝে আমাকে চুইঙ্গাম কিনে দিতো। সে আজ আমাকে ভয়ংকর দৃষ্টি উপহার দিয়েছে।

বাসায় এসে ভালো করে আমার জামাটির দিকে তাকাই। কোথাও আমি কিছু দেখতে পাই না। কিন্তু একটা লজ্জাবোধ আমাকে পেঁচিয়ে ধরে।

বাবাকে আমার পাশের বাসার ভদ্রলোক মনে হয়। আমার সব আবদার ছিল বাবার কাছে। এখন আমি বাবাকে ধরতেও পারি না। একটা সংকোচ আমাকে জাপটে ধরে। সার্বক্ষণিকভয়ে থাকি কখন বাবার মুখোমুখি হয়ে যাই। এতো আমারই বাবা। তবে এই সংকোচ কেন? এই অযৌক্তিক অচেনা বিরক্তিকর সংকোচবোধ আমাকে টেনে হিঁচড়ে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে বাবা থেকে।

বাবার চোখে চোখ তুলে তাকাই না কতদিন? ভুল করে যদি বাবা তাকায় আমার দিকে, বাবার চোখে কিসের যেন একটা লজ্জা দেখতে পাই। এই কী সেই বাবা, যার কোলেই একসময় আমি ঘুমাতাম?

তবে কি শুধু একা আমি ভাঙছি না? বাবাও ভাঙছে?

কিছুদিন আগেও আমি দোকানে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে কোকাকোলা, খাতা, পেন্সিল, কলম কিনতাম। আজও গিয়েছি। উড়তে উড়তে। কোক খাবো, নতুন খাতা কিনবো এই খুশিতে।

“ভাইয়া, একটা কোক আর একটা এক দিস্তা কাগজ দেন তো”।

আমি কাগজ নিয়ে সাদা পৃষ্ঠাগুলো উলটে-পালটে দেখছিলাম। নতুন খাতা নতুন বই দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। পৃষ্ঠায় হাত রাখলে এক নরমভেজা ভেজা শীতল অনুভূতি পাই। আমার হাত তাতে সুখ পায়।
হঠাৎ চমকে উঠি। বুকে কারও হাতের থাবা অনুভব করি। চেয়ে দেখি দোকানদার ভাইয়াটার থাবা আমার বুকের মধ্যে।

এক ভয়ংকর, অন্ধকার, অজানা ভয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। পালিয়ে বাসায় এসেও কাঁপতে থাকি। থাবা লাগা বুকে চিনচিনে ব্যথা লাগে। ভয়ে জর্জরিত মাকে বলতে যাই, মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আবার চমকে উঠলাম মার কথা শুনে।

“তোমারিই তো দোষ, এভাবে যখন-তখন দোকানে গেলে তো এমনই হবে। আর কখনো যাবা না”।

নিজেকে আমার অশুচি মনে হয়। নোংরা নর্দমার কীট মনে হয়। তীব্র অপরাধবোধে আমি বিহ্বল হয়ে যাই। “তোমারিই তো দোষ” কানে বাজতে থাকে। ঘৃণায় অপমানে লজ্জায় নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

আমি খেতে যাই অপরাধবোধ নিয়ে। ঘুমোতে যাই অপরাধবোধ নিয়ে। স্কুলে যাই অপরাধবোধ নিয়ে। পড়তে বসি অপরাধবোধ নিয়ে।

সেদিন ফুফু আসে বাসায়। আমাকে বেড়াতে নিয়ে যায়, যেমনটা নিয়ে যেতেন মাঝে মাঝেই। হঠাৎ ফুফুর আচরণে আমি বধির হয়ে যাই। তিনি আমাকে ছুঁতে চান। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমার মুখে তিনি লালা মিশাতে চান। ভেতর থেকে বমি ঠেলা দিয়ে আসে। ফুফুর চোখে কামনায় ঝলসানো লালসার দৃষ্টি দেখে আমি অন্ধ হয়ে যাই।

মনে পড়ে সেই দারোয়ানের দৃষ্টির কথা, সেই দোকানদারের থাবার কথা। ব্যাকুল হয়ে ফুফুর ভয়াবহ চাপের নিচ থেকে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করি। দমবন্ধ করে দৌড়াতে থাকি। যেন আমি অনন্তকাল ধরে দৌড়াচ্ছি। অবশেষে ক্লান্ত হই। আমার রুমের বিছানাকে শেষ নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে হয়। মাকে জড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মাকে বললে মা যে আমাকেই দায়ী করবে। আবারও হয়তো বলবে “তোমারি তো দোষ”।

অসহায় সঙ্গিহীন আমি ডুকরে কেঁদে উঠি।

বহুদিন পর একদিন আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করি।

আমি কি ঘৃণা করি আমাকে?

না। কখনই না। এ আমার শরীর। আমার অস্তিত্ব। আমার চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে এই শরীরের মাধ্যমে। এ সুন্দর বিশুদ্ধ নির্মল কোমল টলমলে। এবং আরো ভয়ংকর সুন্দরের দিকে এগুচ্ছে। এর মাঝে লুকিয়ে আছে একটি মন। যা কখনো চায়নি বড় হতে। চায়নি এই শরীরটা এভাবে বদলে যাক। চেয়েছে যেমন কোমল ছিল তেমনি থাকতে। কিন্তু এটি এমন আর থাকতে চায়না। সে বদলে যাচ্ছে। ভয়ংকর সুন্দর ভাবে বদলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে কোমল ভাবে এর প্রতিটি ভাঁজ খুলছে। যেমন প্রজাপতির জন্ম হয় রেশম গুটি থেকে উড়ার জন্য। যেমন ফুল আড়মোড়া দিয়ে জাগে সুবাস ছড়ানোর জন্য। যেমন পুকুরে ধীরে ধীরে পানি জমে টলমলে ভরপুর হওয়ার জন্য। আমিও তেমনি নতুন অজানা সুন্দরের দিকে পা বাড়াচ্ছি।

এই সুন্দরকে অপমান করার অধিকার কারো নেই। এমনকি আমারও নেই।

ধীরে ধীরে আমি জেগে উঠছি। ধীরে ধীরে আমি ভাঙছি। ধীরে ধীরে আবার নতুন করে গড়ছি। ধীরে ধীরে আমি বেড়ে উঠছি…।

শেয়ার করুন: