ফারজানা কাজী:
নারীর পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে তার পরিবার। একই পরিবারে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে কখনোই সমান সুযোগ পায় না। ছেলেটি জ্ঞান হবার পর থেকেই শিখে যায় সে স্বাধীন, তার কখনো কোনো কিছুর জন্যেই কারো কাছে অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই। মেয়েটিও কিন্তু বুঝে যায় তার পায়ে অদৃশ্য শিকল পরানো হয়েছে, তাকে সব কিছুতেই জবাবদিহি করতে হবে। নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণেও বাইরে যেতে হলে তাকে অনুমতি নিতে হবে পুরুষ অভিভাবকের কাছ থেকে। ছোটো ভাইটিও কখনো কখনো মেয়েটির অভিভাবক হয়ে যায় পুরুষ হবার কারণে।
মেয়েটি বড় হয়ে হঠার সময়ে পরিবারের লোকজন এক রকম আশঙ্কায় দিন কাটায়। মেয়েটিকেও জুজুর ভয় দেখাতে শুরু করে তারা- ‘বাইরে গেলেই তুমি হারিয়ে যাবে, তোমার জন্য বাইরের জগতে ওঁত পেতে আছে বিপদ’।
আসলেই কি তাই? হ্যাঁ, নারীর পদে পদে বিপদ হতে পারে, তাই বলে কি বাইরের জগতের সাথে তার পরিচয় ঘটবে না? সে বুঝবে না জীবন কি? পৃথিবী কেমন? নারীকে শিশুকাল থেকে শেখানো হয় যে, সে পৃথিবীতে মোকাবিলা করার জন্যে আসেনি, তার জন্ম সুবিধাজনক ভাবে ব্যবহৃত হবার জন্যে।
বাবা-মায়েদের ভয়টা আসলে অন্য কোথাও! মেয়ে যদি বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হয়ে যায়, চোখ-মুখ ফোটে যায়, তবে তো সে স্বাধীনচেতা হয়ে যাবে, প্রেম করতে শিখে যাবে, নিজের মতো করে বাঁচতে চাইবে। সমাজে তাহলে মুখ দেখানো যাবে না। মেয়ের অভিভাবকেরা যতোটা না মেয়ের বিপদের ভয় করে তার চেয়ে চেয়ে বেশি ভয় পায় মেয়ে যেন মানুষ না হয়ে ওঠে! পাড়া পড়শির কথা শোনার ভয় আর সমাজ নামক এক জুজুর ভয়ে বাবা-মায়েরা তটস্থ থাকে।
একটি মেয়ে জন্ম নেবার পর থেকে একটি ছেলের মতো করে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। তাকে বেড়ে উঠতে হয় বিভিন্ন নিয়ম আর প্রথার কারাগারে থেকে, যেখানে মানসিক বিকাশের চেয়ে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
মেয়েটি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়- এই পৃথিবী তার জন্যে মুক্তমঞ্চ নয়, তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে অনির্দ্দিষ্ট নিয়ম আর নির্বাচিত কিছু স্থান যার বাইরে সে যেতে পারে না। এই শৃঙ্খলিত জীবন থেকে একটি মেয়ে নারী হয়ে উঠে, এর পর বার্ধ্যকের বোঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবী ছাড়ে, কিন্তু বের হতে পারে না পরিবার আর সমাজের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি আর পরাধীনতার বৃত্ত থেকে। নারীর আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলে চায় নারী প্রতিবন্ধী হয়ে থাকুক, থাকুক চিরশিশু হয়ে। নারীর একমাত্র পরিচয় হোক দাসী।
নারীকে মানুষ হয়ে ওঠার প্রধান অন্তরায় তার পরিবার। পরিবারের এই কঠোর নিয়মে বেড়ে ওঠা নারীর মগজ শৃঙ্খলিতই থেকে যায়। একটি মেয়ে তাই পড়াশোনা করে যতোই শিক্ষিত হয়ে উঠুক না কেন, চাকুরি করুক না কেন, তার মস্তিষ্ক পুরুষের শৃঙ্খলিত দাসীই রয়ে যায়।
যে মেয়ে প্রতিবাদ করতে চায়, বেরিয়ে আসতে চায় শিকল ছিঁড়ে, সে হয় বেশ্যা! সমাজের কাছে বেশ্যা হয়ে ওঠার আগেই সে পরিবার, আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে বেশ্যা খেতাব পেয়ে যায়, এটি আমি নিজে দেখেছি।
পিতৃতন্ত্র নারীকে দমন ও শাসনে রাখার জন্যে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন সংস্থা: পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরিবার। রাষ্ট্র সরাসরি নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাই পরিবারের মাধ্যমে নারীকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাকে বাধ্য করা হয় পিতৃতন্ত্রের রীতি-রেওয়াজ মেনে চলতে। নারীর জন্যে আইন ও নাগরিক অধিকার থাকলেও দেখা যায় যে নারী শাসিত হচ্ছে পরিবার দ্বারা।
টিকে থাকার জন্য পিতৃতন্ত্র পুরুষটিকেই দিয়েছে সকল কর্তৃত্ব। পরিবারের প্রধান পুরুষটি ধর্মীয় আচারের নামেই নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। নারীও নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য হয় ধর্মীয় বিধানের বিরোধিতা করতে না পারার অক্ষমতার কারণেই।