পারিবারিক সহিংসতায় এলোমেলো শিশুর মনোজগত

তাসলিমা তামান্না:

সম্প্রতি বলিউডের আমির খান অভিনীত সিক্রেট সুপারস্টার সিনেমাটা দেখলাম। ছবিটার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন টিনএজ মেয়ের জীবনের গল্প নিয়ে। যেখানে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ইনসিয়ার মা প্রতিনিয়তই নির্যাতিত হয় বাবা কর্তৃক। চোখের সামনে মাকে শারীরিক আর মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে দেখে অসম্ভব মানসিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে কাটে মেয়েটির জীবন। বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে মাকে বারবার সে বলে বাবাকে ছেড়ে চলে আসতে। এতোকিছুর পরেও নিজের সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন সে হারিয়ে যেতে দেয় না। স্বামীর প্রচণ্ড বাধার মুখেও ইনসিয়ার মা মেয়ের স্বপ্নপূরণে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে। এক সময় ইনসিয়া সাফল্যও পায়। আর নির্যাতিত মাকে বের করে আনে বিভীষিকাময় সেই সংসার থেকে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠলেও ইনসিয়া তার স্বপ্ন থেকে দূরে সরে যায়নি, নির্যাতিত মাকেও প্রতিনিয়ত সাপোর্ট করেছে, যা খুবই পজিটিভ । তবে এমন সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সব সন্তানের গল্প সিক্রেট সুপারস্টার সিনেমার ইনসিয়ার মতো হয় না।

গবেষণা বলছে, সারা বিশ্ব জুড়ে শিশুরা প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের মধ্যে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করছে। খোদ আমেরিকাতেই ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তত ৩০ থেকে ৪০ লাখ বাবা-মায়ের সহিংসতা দেখে বড় হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ নারী তার স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০১১ সালের এক সার্ভেতে জানা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৮৭ শতাংশ নারী বিবাহিত জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারীই শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার। আর মানসিকভাবে যে কত নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তার সঠিক তথ্য তুলে ধরা কঠিন।

পরিচিত একটি পরিবারের কথা বলছি। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত। সেই হিসাবে সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে তাদের অবস্থান যথেষ্টই দৃঢ়। আট বছর বয়সী তাদের একজন সন্তান আছে। সে-ও রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে লেখাপড়া করে। পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুদের কাছে এই পরিচয়টুকুতেই আপাতদৃষ্টিতে হয়তো এই পরিবারটি সুখী পরিবারের উদাহরণ হতে পারতো। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ এই পরিবারে চলে নিত্যদিনের অশান্তি। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার স্ত্রীটির কাছে জানতে পারি, চিৎকার, চেঁচামেচি ও কিংবা ঝগড়াঝাঁটি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আর মাঝেমধ্যে এই দম্পতির দ্বন্দ্ব এমনই চরমে পৌঁছে যায় যে, স্বামী ভদ্রলোক তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেও পিছপা হোন না। আর এই দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁদতে থাকে শিশুটি।

‘এমন অশান্তির মধ্যে আছেন কেন’ জানতে চাইলে স্ত্রীটির উত্তর, ছেলেকে তার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। তাছাড়া পরিবারের অমতে আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। সেই ভালবাসার মানুষটিরই এমন ভয়ংকর রূপ আমি কোন মুখে আমার পরিবারকে বলবো। আশঙ্কার কথা হলো, ইদানিং দেখছি দীর্ঘদিনের পরিচিত সেই পরিবারের শিশুটি হঠাৎ করেই বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। কারণে-অকারণে জেদ করছে, খেলার সাথীদের খেলনা ছিনিয়ে নিতে মারামারি করছে , এমনকি কারো কথাই সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে না।

এবার আসি পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠা অন্য একটি মেয়ের মানসিক টানাপোড়েনের গল্পে। মেয়েটির কাছেই জানতে পারি, ছেলেবেলায় কখনো কখনো বাবা-মায়ের ক্ষোভ গিয়ে পড়তো তাদের দুই বোনের ওপর। কারণে -অকারণে বকাবকি কিংবা মার খেতে হয়েছে তাদের। এখন তারা দুই বোনই বড় হয়েছে। কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাও তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

মেয়েটি জানায়, বাবা-মায়ের এতো বেশি সহিংস রূপ সে দেখেছে যে, কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতেও তার ইচ্ছে হয় না।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, যেসব শিশু পারিবারিক সহিংসতার মধ্য দিয়ে বড় হয়, তাদের মধ্যে পারিবারিক কথা গোপন রাখার মানসিকতা দেখা যায়। আর যেসব শিশু বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়, তারা বাইরের পৃথিবীতে ভালো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। কখনো কখনো তারা ভাইবোন বা মায়ের ওপরও তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা রাগ, হতাশা কখনো বা অপমানবোধে ভোগে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এসব শিশু ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, বিষাদ, হতাশার মধ্যেও ডুবে থাকে। এমনকি তাদের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। শুধু তাই নয়, যেসব শিশু বাবা কর্তৃক মায়েদের নির্যাতিত হতে দেখে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে এক ধরনের ট্রমায় ভোগে। এছাড়া তারা পিতা-মাতার এই সম্পর্ককেই নিজেদের আদর্শ বলে মনে করে। ভবিষ্যতে নিজেদের জীবনের যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে সহিংসতাকেই তারা প্রাধান্য দেয়। আর যেসব ছেলে শিশু বাবা কর্তৃক মাকে নির্যাতিত হতে দেখে তারা নারীদের অসম্মান করতেও শেখে। তারা মনে করে, তাদের বাবা যে আচরণ তাদের মায়ের সঙ্গে করছে, নারীদের সঙ্গে সেই আচরণই করতে হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত আরেকটি জরিপে পরিবারে শিশুর ওপর মা-বাবার মানসিক চাপ ও শারীরিক পীড়নের যে চিত্র ওঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। সেখানে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ শিশুকে মারধর করেন মা-বাবা। প্রতি তিনজন মায়ের মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন, নিয়মকানুন শেখাতে সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।

কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও শারীরিক শাস্তি শিশুর মনোজগতের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমন হলে বড় হয়ে তাদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই। কিন্তু সেই মা-ই যদি সন্তানের ওপর নির্যাতন চালান তাহলে সেটা তার মনোজগত এলোমেলো করে দিতে পারে। তবে এটাও দেখা দরকার, যেসব মা সন্তানকে কথায় কথায় শাস্তি দেন, তারাও কোন না কোনভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার কি-না। এখানে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনের কথাও বলছি।
পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সব শিশুই যে ভবিষ্যতে নেতিবাচক ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠবে তা বলছি না। অনেকে আছেন, নিজের শৈশবের নেতিবাচক ঘটনাটাগুলো যেন তার জীবনে প্রভাব না ফেলে সেই ব্যাপারে সচেষ্ট থাকেন। তবে সেজন্য দৃঢ় মানসিকতা থাকা দরকার।

এটা মনে রাখা দরকার, সহিংস পরিবার কখনোই শিশুর বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনো অধিকাংশ সংসারে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বিদ্যমান। যেখানে অনেক স্বামীই মনে করেন, স্ত্রীকে মারধর করা বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করা তার নৈতিক অধিকার। অথচ এই স্বামী হয়তো বুঝতেই পারছেন না, নিজের সন্তানের সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করে তিনি সন্তানের, দেশের ভবিষ্যতের কতটা ক্ষতি করছেন।

শুধু আইন দিয়ে পারিবারিক সহিংসতা রোধ করা যাবে না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করা জরুরি। সর্বোপরি মনে রাখা দরকার ,আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। ভয়, আতঙ্ক কিংবা নিরাপত্তাহীনতা নয়, বরং প্রতিটি শিশুর শৈশব হয়ে ওঠুক রঙিন আর স্বপ্নময়। তাদেরকে ঘিরে থাকুক অসংখ্য মঙ্গলপ্রদীপ আর আলোর ঝর্ণাধারা- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

শেয়ার করুন: