পুরুষ যখন ভিকটিম – পর্ব (৩)

প্রমা ইসরাত:

জানুয়ারি-
বাণিজ্য মেলা- সিভিল ড্রেস (হুদাই ঘুরাঘুরি +টুকটাক কেনাকাটা+খাওয়া+যাতায়াত)=৫০০০/-

ফেব্রুয়ারি-
পহেলা ফাল্গুন-(বাসন্তী-হলুদ-সবুজ) পোশাক (শাড়ি/সালোয়ার-কামিজ/পাঞ্জাবী+এক্সেসরিজ)-৫০০০/-
ঘোরাঘুরি+ফুলের মুকুট+ খাওয়া+ যাতায়াত-২০০০/-
টোটাল= ৭০০০/-

ভ্যালেন্টাইন্স ডে-
গিফট-২০০০/- (ফুল/বেলুন+চকলেট+কার্ড+গিফট+গিফট এর প্যাকেট)
(লাল/গোলাপী/) পোশাক –২০০০-৫০০০/-
খাওয়া+যাতায়াত- ৩০০০/-
টোটাল= ১০,০০০/-

২১ শে ফেব্রুয়ারি-
(সাদা-কালো) পোশাক-২০০০/-
অমর একুশে বইমেলা
বই= ৩০০-৫০০/-
খাওয়া+ যাতায়াত= ১০০০/-
টোটাল= ৩৫০০/-

মার্চ-
২৬ মার্চ
(লাল-সবুজ)পোশাক-৫০০০/-
খাওয়া + যাতায়াত- ২০০০/-
টোটাল= ৭০০০/-

এপ্রিল-
পহেলা বৈশাখ-
(লাল-সাদা)পোশাক-৬০০০/-
খাওয়া+ যাতায়াত-৩০০০/-
মেলার জিনিস-( বাঁশি, মুখোশ, হাবিজাবি)= ১০০০/-
টোটাল=১০,০০০/-

প্রেমিকের জন্মদিন- গিফট+কেক+মোমবাতি=২০০০/-
জন্মদিনের ট্রিট- শুধু প্রেমিকা থাকলে ৩০০০/- বন্ধুবান্ধব ৫০০০/-

প্রেমিকার জন্মদিন-কেক+বেলুন+ফুল+মোমবাতি+কার্ড=২০০০/-
গিফট-৫০০০/-
জন্মদিনের ট্রিট- ৩০০০/- দরকার পড়লে এটিএম বুথ
টোটাল= ১০,০০০/-

বন্ধু বান্ধবের জন্মদিন-
ট্রিট দিলে গিফট ৩৫০-৬০০/-
ট্রিট না দিলে ২০০-৩০০/-

ধর্মীয় উৎসব -কারণ ধর্ম যার যার ফূর্তি সংখ্যাগুরুদের
চান রাতের ফূর্তি- (আনুমানিক) -১০,০০০/-
ঈদ- গিফট+যাতায়াত+খাওয়া= ১০,০০০/-
পূজা- ঘোরাঘুরি+খাওয়া =২০০০/-
ক্রিসমাস- ঘোরাঘুরি+ খাওয়া = ২০০০/-

ডিসেম্বর-
বুদ্ধিজীবী দিবস- (কালো) পোশাক বাজেট থাকলে-২০০০/- নইলে ২১ শে ফেব্রুয়ারির টা
বিজয় দিবস- (লাল-সবুজ)বাজেট থাকলে -২০০০/- নইলে ২৬ শে মার্চের টা
৩১ শে ডিসেম্বর-
পানীয় – সংখ্যা অনুযায়ী চাঁদা ধরা হবে

স্টার সিনেপ্লেক্স- টিকেট + পপকর্ণ+ পেপসি+ যাতায়াত+ফুড কোর্ট= ৩০০০/-
কনসার্ট/ডিজে=২০০০/-
পিকনিক-১০০০/-
পিঠা উৎসব- ১০০০/-
মোবাইল- যোগাযোগ ৩০০/-* ১২= ৩,৬০০/-
ইন্টারনেট-(ইন্সট্যান্টলি চেক ইন + ফটো আপ্লোড) ৫০০/- * ১২= ৬,০০০/-
বাসার ওয়াইফাই- রাওটার-২২০০-২৫০০/- ইন্টারনেট-৬০০/-
ফাউল -৩০,০০০/-

(হঠাৎ ঘুরাঘুরি/পছন্দ হইছে কিনছি/ গার্লফ্রেন্ড চাইছে/ হঠাৎ দাওয়াত/ দোস্ত বন্ধুর জন্য/মন খুব খারাপ ছিল/ মন খুব ভাল ছিল/ প্যারাতে পড়ছি/ বাইজ্জা গেছি/)
=১,৩২,৫০০/- (প্লাস মাইনাস। )
গড়ে প্রতিমাসে, ১১,০০০/- থেকে ১২,০০০/- টাকা।

উপরের এই হিসেবটি আমার আনুমানিক হিসেব, অনেকেই হয়তো এই দিবসগুলিতে এর চেয়ে অনেক কম খরচ করেন, কিংবা এর চাইতে অনেক বেশি খরচ করে থাকেন। অনেকে হয়তো বাজেটে এই দিবসগুলিকে রাখেনই না। কিন্তু এই দিবসগুলি বিশেষ মানুষের সাথে সময় কাটানোর একটা সুযোগ করে দেয়, এবং বাজারে নানান প্রচার প্রচারণায় এই দিবসগুলিকে ফলাও করে এমন ভাবে প্রচার করা হয় যে, আমরা সকলেই নিজের ভেতরে চাহিদা অনুভব করি এই দিবস, এবং দিবস অনুযায়ী, নানান রেওয়াজ পালনের জন্য। সে আমাদের এই দিবস পালনের সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক। এবং সমাজের এই রেওয়াজ পালিত হতে হতে এটা এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যে এই দিবসগুলো পালন না করলেই বরং নানান মান অভিমান, ঝগড়া, এবং সম্পর্কের টানা পোড়েন শুরু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্ত চাহিদা পালনের উপর একটি সম্পর্ক টিকে থাকছে। এই চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ধরা হচ্ছে, একজন ব্যক্তির সামর্থ্য।

এখন পুরুষতন্ত্র বলে যে, একজন নারীর বা পুরো পরিবারের সমস্ত চাহিদা পূরণ করবে পুরুষ। একজন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনার নারীও এটাই বিশ্বাস করে যে তাঁর সমস্ত চাহিদা পূরণ করবে পুরুষ। কিন্তু আমাদের এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে শ্রেণী বৈষম্য। তাই এই বিপুল অর্থ দিয়ে এইসব চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্য সকল শ্রেণীর পুরুষের থাকে না। সুতরাং যাদের থাকে, তারা সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে, এবং যাদের থাকে না, তারা একটা হতাশায় নিমজ্জিত থাকে।

একজন পুরুষ এই সমস্ত চাহিদা পূরণ করার উপর ভিত্তি করে, নিজের পৌরুষ জাহির করে। যখন সে তা পারে না, তখন তাকে এই হতাশায় থাকতে হয় যে, সে সামর্থ্যবান নয়, সে পুরুষ নয়, পরিবারকে চালানোর ক্ষমতা তাঁর নেই, বউ পালার মুরোদ তাঁর নাই। নিজেকে তখন সেই পুরুষ অক্ষম মনে করে, আর তাঁর এই অক্ষমতার কথা তাকে মনে করিয়ে দেয় সমাজ, তাঁর পরিবার, তাঁর নিজের জীবনসঙ্গী। তখন একজন পুরুষ নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে, অপরাধী মন নিয়ে হলেও অর্থের জোগানের জন্য পাগল হয়ে ওঠে, আধিপত্য ধরে রাখার জন্য শারীরিক দিকে তুলনামূলক ভাবে দুর্বল নারী এবং শিশুদের উপর চড়াও হয়, হতাশায় নিমজ্জিত থাকে।

যে পুরুষ প্রেমময় হতে পারতো, অনুভূতিশীল হতে পারতো, লাবণ্যময় হতে পারতো, সেই পুরুষকে হতে হয় রুক্ষ, আবেগহীন, রূঢ়। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চায় যেন সে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে, রক্ষা কর্তা, ত্রাণকর্তা, খাদ্য-বস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে, আর তাই পুরুষকে হতে হয় শারীরিক দিক থেকে পেশিশক্তির পূজারি, পুরুষকে হতে হয় অর্থের জন্য দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত, পুরুষকে হতে হয় আবেগহীন। যে পুরুষ মানবিক হতে পারতো, আবেগময় হতে পারতো, পুরুষতন্ত্র সেই পুরুষকে বলে, “পুরুষকে কাঁদতে নেই”।

তাই পুরুষতন্ত্রের আসল ভিকটিম আসলে নারী নয়, পুরুষতন্ত্রের আসল ভিকটিম হচ্ছে পুরুষ নিজেই।
পাখি ড্রেস না পেয়ে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল, সেই মেয়েটির পিতা তাই ভিকটিম, যে প্রেমিকের প্রেমিকা চাকরি পায়নি বলে প্রেমিককে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করলো, সেই প্রেমিক ভিকটিম, যে স্ত্রী শাড়ি গয়না কিনে দিতে পারেনি বলে স্বামীর দিকে অশ্রাব্য বাক্যবাণ এর সাথে ঘটিবাটি ছুঁড়ে দিল, সেই স্বামী ভিকটিম। এবং এর দায় পুরুষতন্ত্রের।
কিন্তু নারী পুরুষের এই বৈষম্যের খেলায় প্রতিপক্ষ টিমের ক্যাপ্টেন যদি হয় পুরুষতন্ত্র, তাহলে সেই টিমের কোচ হচ্ছে পুঁজিবাদ।

লেখক: প্রমা ইসরাত
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

শেয়ার করুন: