রহমতউল্লাহ ইমন:
সম্প্রতি ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত ‘বড় ছেলে’ নামের একটি টেলিফিল্ম তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। যার সাথে কথা হয় তার মুখেই বড় ছেলের গল্প। সংসারের জন্য একজন বড় ছেলের আত্মত্যাগ সবার চোখে জল এনে দিয়েছে, এতো সুন্দর কাহিনী নির্ভর ছবি সাম্প্রতিক সময়ে আর নির্মিত হয়নি, বড় ছেলে না দেখলে বুঝবেনই না কি দারুণ জিনিস মিস করেছেন ইত্যাদি প্রভৃতি।
না, সত্যি কথা বলতে আমার বড় ছেলে দেখা হয়নি। এমনিতেই ছবি দেখার খুব একটা সময় পাইনা। তারপর যে ছবির ওপরে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার প্রতি কেমন যেন এক বিতৃষ্ণা জন্মে যায় আমার। আর এই কারণেই এই সময়ের আরেকটি ক্রেজ ‘আয়নাবাজি’ দেখা হয়নি আমার। আর আমি যেহেতু এই ছবির সমালোচনা লিখতে বসিনি, তাই এটা না দেখা কোন অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। তবে ছবিটি না দেখলেও এর উপজীব্য কী, সেটা কানে এসেছে।
চোখ যতো সহজে বন্ধ করে রাখা যায় কান তো আর তেমনটা করা যায় না। যতটুকু যা শুনেছি তা হলো উচ্চশিক্ষিত এক বেকার ছেলে তার ওপরে চেপে থাকা সংসারের বোঝা টানতে যেয়ে তার প্রেমিকাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। ছেলেটির সংসারে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী বাবা আছেন, মা আছেন, ছোট ভাইবোন আছে। তার রেজাল্ট ভালো, তারপরেও দুর্মূল্যের বাজারে চাকরি হচ্ছে না। প্রেমিকা উচ্চবিত্ত পরিবারের- তার বিয়ের জন্য পাত্রসন্ধান চলছে। ছেলেটি হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না- মেয়েটি বারবার বিয়ের সম্বন্ধগুলো ভেঙ্গে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে মেয়েটির বাবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়- যেভাবেই হোক মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। ওদিকে অপ্রস্তুত বড় ছেলেটি সংসারের প্রতি তার দায়িত্ব কর্তব্যের কথা মনে রেখে নিজের প্রেমকেই বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই দায়িত্ববোধের কাছে প্রেমের জলাঞ্জলির মাধ্যমে এক বিয়োগান্তক পরিণতি ঘটে কাহিনীর।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবারে এমন ধরনের হায়ার্কিই বিরাজ করে। বাবা হলেন পরিবারের কর্তা- তার অবর্তমানে বড় ছেলে। এই দায়িত্ব সমাজই তাকে অর্পণ করে। সব ছেলেরাই নিজেদের ভবিষ্যতের কর্তা বলে ভাবতে শেখে। একটি বাংলা প্রবাদ আছে- বড় গাছে ঝড় বেশি লাগে। সেটিও কিন্তু বড় ছেলের বেশি কর্তব্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সে না চাইলেও এই কর্তব্যের ভার তার কাঁধে এসে চাপে- সে যে কর্তা। যাই হোক এই গল্পের অনেকটাই এখনও অজানা। ছেলেটি নিশ্চয়ই পরে একটা চাকরি পেয়েছিল। সে কি তখনও মনে রেখেছিল তার সেই প্রেমিকাকে? কখনো অন্যমনে প্রেমিকার দেয়া উপহারগুলো দেখে তার চোখ অশ্রসজল উঠতো? না কি আটপৌরে আর দশটা কাহিনীর মত সেও সাজিয়ে নিয়েছিল নিজের জীবন- নতুন মেয়ে, নতুন সংসার? তার প্রেমিকার সেই ত্যাগ হয়ে গিয়েছিল নিতান্তই অপাংক্তেয়?
এতোক্ষণ তো হলো বড় ছেলের কথা। এবার আপনাদের শোনাবো একজন বড় মেয়ের কাহিনী। না, কোন গল্প উপন্যাসের কাহিনী নয়- জীবন থেকে নেয়া সত্য ঘটনা। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘটনা- আমাদের গ্রাম বাংলার।
খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়েছে মেয়েটি। তার একমাত্র ছোটভাই তখন মায়ের কোলে। স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই মারা যান মা। ভাইটি তখনও অনেক ছোট। আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি। আমাদের সমাজ মেয়েদের কর্তা বানায় না- কিন্তু মেয়েটি তার দায়িত্ব কর্তব্য ঠিক করে ফেলে। যেভাবেই হোক তার ছোট ভাইটিকে মানুষ করতে হবে- মানুষের মতো মানুষ। প্রথম কোপ পড়লো নিজের লেখাপড়ার ওপরেই। গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি নিল সে। সামান্য যে কয় টাকা বেতন পায়, নিজে খেয়ে না খেয়ে ছোট ভাইটিকে খাওয়ায়। তার গায়ে অভাবের কোনো আঁচড় লাগতে দেয় না- তার কোনো শখ অপূর্ণ রাখে না। মেয়েটি তখন যৌবনে। সমবয়সী অন্য মেয়েরা যখন নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর, তখনও মেয়েটি একমনে কাজ করে যায়- দাঁতে চোয়াল চেপে কঠোর পরিশ্রম। তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান যেভাবেই হোক মানুষ করতে হবে ছোট ভাইটিকে।
এইভাবে জীবন থেকে ঝরে যায় একের পর এক বসন্ত। ছোট ভাইটি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়ের জন্য কত খরচ। বাড়তি খরচ মেটাতে যেয়ে চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট ট্যুইশনিও করতে হয়। একদিন ছোট ভাইটির লেখাপড়া শেষ হয়। খুব ভাল ফল করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পেয়ে যায় সে। উচ্চশিক্ষার জন্য জুটে যায় বিদেশি স্কলারশিপ। সমাজের দৃষ্টিতে তার নিজের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। তাই সেই ভাবনা আর ভাবতেই চায় না মেয়েটি। কিন্তু ছোট ভাইটির বিয়ে যে দিতেই হবে।
একদিন ভাইটির বিয়ে হয়- হয় সুন্দর সাজানো সংসার। তাদের ঘর আলো করে আসে সন্তান। বড় মেয়েটি তখন জীবন সায়াহ্নে। কাজ তখনো ছাড়েনি তাকে। ছোট ভাইটি শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নামকরা প্রফেসর হয়েছে তাই নয়- সে হয়েছে সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ। নানাভাবে সে চেষ্টা করে বড় বোনকে সুখি করতে। কিন্তু মেয়েটির চাহিদা তো খুবই সামান্য। নিজেই মেহনত করে তা পুষিয়ে নিতে পারে সে।
আমাদের সমাজ মেয়েটিকে কর্তা বানায়নি- কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে বড় মেয়েটি একদিন স্বপ্রণোদিত হয়ে তুলে নিয়েছিল সংসারের বোঝা নিজের কাঁধে। নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সে বড় করে তুলেছে তার ভাইটিকে। তার এই ক্রমাগত ছুটে চলার মাঝে জানি না কখনও কাউকে তার ভালো লেগেছে কি না? চলার পথে কখনো কি মনে হয়নি কেউ পাশে এসে হাতটা ধরুক, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত এলো চুল ঠিক করে দিক কেউ, জ্বরতপ্ত কপালে কেউ একটু প্রশান্তির হাত বুলিয়ে দিক, এগিয়ে দিক এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় জল। আর সবার মতো সেও কি একবারও ভাবেনি স্বামী সন্তান নিয়ে হোক তার সুন্দর সুখের এক সংসার!
নিশ্চয়ই হয়েছে, সেও তো রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। কিন্তু কোনদিন কেউ হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করেনি এর কিছুই, জানতেই চায়নি তার স্বপ্ন- তার ব্যথা।
বড় ছেলেদের আত্মত্যাগ নিয়ে গল্প লেখা হয়, হয় নাটক ফিল্ম- বড় মেয়েদের আত্মত্যাগ নিঃশ্বাসে মিলিয়া যায়- তাদের নিয়ে হয় না কিছুই।