নপুংসক করে দাও

জাজাফী:

কখনো ভাবিনি এমন একটি শিরোনাম দিয়ে কোন লেখা শুরু করবো। আফসোস এমন দিন আসলো যে বাধ্য হয়ে এমন একটি কথাও আমাদেরকে লিখতে হচ্ছে। গত বছর শ্রদ্ধাভাজন কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আরেক কবি ও অভিনেতা সোহেল রশিদ তার একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন যার শিরোনাম ছিল “আমাকে নপুংসক করে দাও”।

সেদিন সেই কবিতার শিরোনাম শুনে মনে মনে আমারও হাসি পেয়েছিল। আমি জানি সেদিন বাকিরাও মনে মনে হেসেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য আজ সেই লাইনটিকেই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। স্বাধীন দেশে যে হারে প্রতিনিয়ত নারী নিযার্তন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে তা দেখে পুরুষ হিসেবে আমার লজ্জা হচ্ছে এবং সত্যি সত্যিই কবি সোহেল রশিদের কথা ধার করে বলতে হচ্ছে “আমাকে নপুংসক করে দাও”।

জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে বেশ কিছুদিন আগে বনানীতে হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি, তার মাঝেই পত্রিকায় শিরোনাম হলো আরো একজনকে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেই মামলা বিচারাধীন থাকার মাঝেই আবার শিরোনাম হলো ‘সাভারে দুই মডেল গণর্ধষণের শিকার’।জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করছে, অভিনয়ে সুযোগ করে দেবে বলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করছে, যেন গোটা দেশ ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

পত্রিকা পড়তে ভয় পাই। পত্রিকার পাতায় পাতায় আশা জাগানিয়া সংবাদ পাই না একটাও। পাতা ওল্টালেই ধর্ষণ, খুন,গুম নানা অসংগতি চোখে পড়ে। এই দেশটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীন করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু যেরকম একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমরা মনে মনে যেরকম একটি দেশ পাবো বলে কল্পনা করেছি, তার সবটাই মিথ্যে হতে চলেছে। সামাজিকভাবে আমাদের এতোটাই অবক্ষয় হয়েছে যে এক বছর বয়সী শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউ আর নিরাপদে দিনযাপনের আশা করতে পারছে না। কী রাস্তায়, কী অফিসে, স্কুলে এমনকি বাড়িতেও নারী,শিশু,কিশোর যৌন নিযার্তনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

টেলিফোন কোম্পানি রবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং লেখক ইকরাম কবীর আক্ষেপ করে প্রশ্ন রেখেছেন, “আমিও কি একজন ধর্ষক? স্বাধীনতার পর এদেশে যে পরিমাণ নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে তার হিসেব করলে বোধহয় আমার মাথায়ও গোটা চারেক ধর্ষণের দায় পড়ে”। ইকরাম কবীরের প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিক ও অভিনেতা হাসান মাসুদ রসিকতা করে বলেছেন, “আমি আর কোনদিন বনানীতে জন্মদিনে যাবো না”। যদিও কথাটি তিনি এ সমাজের ওই সব কুলাঙ্গারদের কটাক্ষ করতেই বলেছেন। আমাদের দেশে অনেক সমস্যা বিরাজমান, যার কোনোটিই কোনটি থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে নারী নিযার্তন, ধর্ষণ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের ছেলেদের কী হয়ে গেল যে তারা একাত্তুরের সেই সব হিংস্র হায়েনাদের মতো নারীদের উপর অত্যাচার শুরু করেছে। এখন মনে হচ্ছে ওই সব ধর্ষকদের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা দরকার, ওরাও সেই সব কুলাঙ্গারদেরই বংশপরম্পরা কিনা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের অর্জন নেহায়েত কম নয়। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, দেশকে পোলিওমুক্ত করেছি,দেশে শিক্ষার হার বাড়িয়েছি, নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছি, ক্রিকেটের সব পরাশক্তিদের মাটিতে নামিয়ে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছি, এভারেষ্টের বুকে পদধুলি রেখেছি, গিনেস বুকে অগনন রেকর্ড গড়েছি, এবং নানা বিষয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছি। আমরা শিশু মৃত্যুর হার কমিয়েছি, বাল্যবিবাহ কমিয়েছি, নারী শিক্ষাকে আরো বেগবান করেছি, নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত রেখেছি, কিন্তু শুধু নারী ও শিশু নির্যাতনটাই রোধ করতে পারিনি। সেটা যেন বন্যার পানির মতো হুহু করে বেড়েই চলেছে। এদেশে যেন ধর্ষকদের জোয়ার এসেছে। আমরা সবকিছু ঠেকাতে পারছি, কিন্তু ধর্ষকদের ঠেকাতে পারছি না।

কদিন আগে কামরুন নাহার নামে এক লেখিকা লিখেছিলেন, “এ শহরে যৌনপল্লি দরকার”। কিন্তু তাতেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে? যৌনপল্লি হলেই কি ধর্ষকরা থেমে যাবে? মোটেই তা যাবে না। আমরা পত্রিকাতে যে সব ধর্ষণের ঘটনাগুলো দেখতে পাই, তার অধিকাংশই উচ্চবিত্তদের ছেলেদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। আর ওই শ্রেণির ছেলেরা নিশ্চয়ই যৌনপল্লিতে যাবে না। কিন্তু আমি বলছি না যে ধর্ষক কেবলমাত্র উচ্চবিত্তে সীমাবদ্ধ। বরং সব শ্রেণির মাঝেই ধর্ষক লুকিয়ে আছে, তবে সবগুলো আমাদের সামনে আসে না বলে আমরা জানতেও পারি না।

পত্রিকার পাতায় নারী নিযার্তনের যে সংবাদ আমরা প্রতিনিয়ত পাই, তা প্রকৃত পরিসংখ্যনের কিয়দংশ মাত্র। আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়তই নারী ও শিশু নির্যাতিত হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সবগুলোর খবর পত্রিকায় আসে না বলেই আমরা জানতে পারি না।

ধর্মভিত্তিক দলগুলো বলে থাকে নারীদের পর্দার অভাবেই তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এটা একটা গাঁজাখুরি কথা ছাড়া আর কিছু নয়। নারীর পর্দার সাথে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। এটা কোন নিয়মে লেখা আছে যে নারী পর্দায় থাকলে তাকে ধর্ষণ করা হবে না, আর পর্দায় না থাকলে ধর্ষণ করতে হবে? যে শিশুটির বয়স চার বছর সেও তো নির্যাতিত হচ্ছে। ধর্ম কি চার বছরের শিশুর জন্যও পর্দার কথা বলেছে?

এ শহরে যৌনপল্লি হলেও যেমন ধর্ষণ ঠেকানো যাবে না, তেমনি নারীকে শুধু পর্দা করতে বললেও ধর্ষণ কমবে না। আগে চাই পুরুষের সচেতনতা। এখন যারা শুধু পর্দার দোহাই দেয় তারা কি কখনো ভেবে দেখেছে পর্দা আগে নাকি দৃষ্টিকে সংযত রাখা আগে? আমি যদি আমার দৃষ্টিকে সংযত রাখি তাহলে কোনো তরুণী বিবস্ত্র হয়ে রাস্তায় হাঁটলেই কী, আর বোরখায় সমস্ত শরীর ঢেকে হাঁটলেই কী!

ধর্ষকদের কোন ধর্ম থাকে না, কোন জাত থাকে না। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা ধর্ষক। এ সমাজ ধর্ষকদের কোন ভাবেই দমন করতে পারছে না। তারা কোন না কোন ভাবে পার পেয়েই যাচ্ছে। যদি আইন আরো কঠোর হতো, তাহলেই কেবল ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব হতো। যারা ইতোমধ্যে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তাদেরকে খোজা করে দেওয়া হোক। জেল জরিমানা করে কোন লাভ নেই। যাদের টাকা আছে তারা অনায়াসেই জরিমানা পরিশোধ করবে, আর যাদের নেই তারা কদিন জেল খেটে বেরিয়ে আসবে, কিন্তু তাদের ভিতরের পশুত্বটা থেকেই যাবে আর ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো যখনই সুযোগ পাবে নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সুতরাং তাদের এমন কঠোর শাস্তি দিতে হবে যেন স্বপ্নেও কোনদিন নারী নিযার্তনের কথা ভাবতে না পারে। আর সেই শাস্তি দেখে যারা ভবিষ্যতে নারী ও শিশু নিযার্তন, ধর্ষণের কথা ভাবতে সাথে সাথে শিউরে উঠবে এবং ওপথে পা বাড়ানোর সাহস পাবে না। কিন্তু তারপরও কি ধর্ষণ থামবে? না থামবে না। এটা এমন একটা রোগ যা সমাজ থেকে পুরোপুরি দুরীভূত করা সম্ভব নয়। তবে এসব পদক্ষেপ নিলে সমাজ থেকে অনেকাংশেই ধর্ষণ কমে যাবে।

এ দেশের প্রায় সবাই নানা ভাবে নারীকেই দোষারোপ করে থাকে। পুরুষ ছেলেরা এ ক্ষেত্রে বলা চলে সব ধরনের অভিযোগের বাইরে। কেবলমাত্র মেয়ে শিশুকে পর্দার অভ্যাস না করিয়ে বরং ছেলেশিশুকেও সচ্চরিত্রবান করে গড়ে তোলা উচিত। মেয়েদেরকে কেবলমাত্র মা বোন মেয়ে হলেই যে সম্মান দেখাতে হবে আর ওই তিন সম্পর্কের বাইরে কিংবা অপরিচিত মেয়ে হলে তাকে সম্মান দেখাতে হবে না, এটা ভাবলে হবে না। নারী নিযার্তনের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ দোষ অবশ্যই পুরুষের।

তাই আমাদের সমাজ থেকে নারী ও শিশু নিযার্তন, ধর্ষণ কমাতে হলে শিশুকাল থেকেই আমাদের ছেলে শিশুদের চরিত্রের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। ছেলেরা যদি তাদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে কোন ভাবেই ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব নয়। বাবা মাকে সন্তানের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। সন্তান কিভাবে বেড়ে উঠছে, কাদের সাথে চলাফেরা করছে, সেসব খেয়াল রাখতে হবে। চাই সেটা ছেলে সন্তানই হোক আর মেয়ে সন্তানই হোক। সন্তানের দিকে নজর না দিয়ে তাকে অবাধ বিচরণের সুযোগ দেওয়ার ফলে সমাজে অপকর্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন দিন এসে গেছে যে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে বাবা মেয়েকে নয় বরং তোমার ছেলেকে সামলাও, ছেলে ভালো থাকলে সমাজের মেয়েরা আপনাআপনিই ভালো থাকবে।

শেয়ার করুন: