“আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি” – ধর্ষণের প্রতিবাদে একজন শিল্পী

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

বিশালাকৃতির দুটি ছুরি ও কাঁটা চামচের নিচে নিজেকে রক্ষার মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে উজ্জ্বল সবুজ দেহের এক নারী অবয়ব। অভিব্যক্তিতে ভয়কে অতিক্রম করে ব্যক্ত হয়েছে যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, – সব মিলিয়ে এক গগনবিদারী আর্তনাদ। অনেক হয়েছে, মুক্তি চাই!

এমন একটি ছবি যখন দেখি, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, থামতে হয়। দৃষ্টি সেখানে স্থির হয়। খুব অচেনা তো লাগে না! নারীর প্রতি সহিংসতার যে চিত্র প্রতিদিন আমরা চারপাশে ঘটতে দেখি, এ তো সেই ভয়াবহতারই চিত্র!
অখাদ্য পুরুষের খাদ্য তালিকায় নারীর রক্তমাংসই যে দিনের সেরা মেন্যু!

সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় একটি হৃদয়স্পর্শী, বলিষ্ঠ কনসেপ্টের জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য শিল্পী জুনায়েদ মোস্তফার, সমসাময়িক শিল্পীদের মাঝে বরাবরই যিনি একটু ভিন্নধর্মী কাজ করতে স্বচ্ছন্দ।
তাঁর কাজের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো তুখোড় perspective sense। অদ্ভুত রকমের খ্যাপাটে ভাব আছে তাঁর ভাবনায়, ক্যানভাসে, তুলির আঁচড়ে।
বাংলাদেশে “বডি পেইন্টিং” এর মতো “Bold and Beautiful” ধারায় একমাত্র জুনায়েদ মোস্তফাই কাজ করেন, যতদূর জানি।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত অপরাধের খবরগুলো থেকে যে গভীর উদ্বিগ্নতার জন্ম, তা থেকেই জুনায়েদের এ নিয়ে কাজ করার ভাবনা মাথায় আসে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সিদ্ধান্ত নেন প্রতিবাদ করার। একজন শিল্পী হিসেবে কাজের নিজস্ব মাধ্যমই হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র বা ভাষা।

পাঁচ দিন, পাঁচ রাত ধরে তৈরি করেছেন আবহ, অনুষঙ্গ, পোশাক। ক্যানভাস বা মডেলের শরীর রাঙাতে গিয়ে বারবারই জুনায়েদের মনে হয়েছে ধর্ষণের শিকার ছোট্ট শিশু ও তরুণীদের একটি প্রাণোচ্ছল, সম্ভাবনাময় জীবন ছিল – যে জীবনের রঙ উজ্জ্বল সবুজ। পোশাকের ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছেন খবরের কাগজ, যে খবরের কাগজের পাতায় প্রতিদিন শিরোনাম হচ্ছে ধর্ষণের খবরগুলো। কাগজে মোড়ানো কোনো কেচ্ছা কাহিনী যেন! পুরনো হচ্ছে, আবার নতুন কেচ্ছা আসছে। অথচ নিছক কাহিনী নয়, প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় বর্বর পুরুষের পৈশাচিকতায় নিভে যায় একেকটি জীবন।

জুনায়েদ মোস্তফা তাঁর এই প্রতিবাদের নাম দিয়েছেন “আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি”।

তাঁর ভাষায় –
“খবরে মোড়ানো ধর্ষণের গল্পে স্থান পায় তনু, রূপা’র মতো হাজার হাজার কিশোরী-তরুণী, বাদ যায় না শিশু- কন্যারাও। ছুরি – কাঁটায় উপাদেয় খাবারের মত নাবালিকার যোনি কেটে সম্ভোগ করার সংবাদও আসে চোখের সামনে ।
তবুও অন্ধ মানসিকতার পিশাচ সত্তাদের মৃত্যু হয় না । “
প্রতিবাদে সকল নারীর পক্ষে শামিল হয়ে আর্তনাদ ব্যক্ত করেছেন অভিনেতা দীপান্বিতা মার্টিন। অনবদ্য উপস্থাপনা। পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস তন্বী। ক্যামেরায় আজমান রুশো।

আগামী প্রজন্মের কাছে শিল্পীর প্রত্যাশা, তারা যেন বিকৃত লালসা থেকে মুক্ত হয়, নারীকে মানুষ ভাবতে শেখে।

জুনায়েদের এ প্রতীকী প্রতিবাদ দেখে আশায় বুক বাঁধি, আমরা একা নই।
আগুন জ্বলুক – প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। এভাবেই এগিয়ে আসুক সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। শিল্পীর ক্যানভাস থেকে রাজপথ –
“এ আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।”

শেয়ার করুন: