কেবল সন্তান জন্মই নয়, একজন মায়েরও জন্ম হয়

হাসিন জাহান:

ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় – সন্তান পালনের দায়-দায়িত্বের বেশিরভাগটাই মায়ের উপর বর্তায়। সময়মতো খাওয়ানো, গোসল-টয়লেট করানো, পড়ালেখায় হাতেখড়ি, স্কুলে আনা-নেয়া, হোমওয়ার্ক করানো, এমনকি জুতোর ফিতে বাঁধতে শিখানো -সবটাই মায়ের জব ড্রেসক্রিপশনের অংশ। অসুখ-বিসুখে সেবা, ডাক্তারের চেম্বার, হাসপাতালে ছুটাছুটি, ওষুধ-পথ্যের তদারকি – সেসবও মায়েরই দায়িত্ব। তবে এসব টুকরো টুকরো দায়িত্ব যোগ হতে হতে একসময় যেন দায়ভার-এ পরিণত হয়ে যায়।

সন্তানের অসুখ-বিসুখের কারণ হিসেবে অনেকসময়ই মায়ের অসাবধানতা বা অমনোযোগিতাকে দায়ী করা হয়। সন্তান শুকনা পাতলা হলে যেন তা শুধুই মায়ের অযত্ন, আবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মোটাসোটা হলে তাও যেন শুধু মায়েরই অতি-আহ্লাদ। আর সন্তান বিপথে গেলে তো কথাই নেই – মায়ের ব্যর্থতা শতভাগ!

জন্মমূহুর্ত থেকে সন্তানের সকল দায়-দায়িত্বের বোঝা মায়ের কাঁধেই চেপে বসে। কেউ কী ভেবে দেখে যে, এই “আনকোরা মা” মাত্র কদিন আগেও ছিল কেবলই একটি মেয়ে! রাতারাতি একটি মেয়ের মা হয়ে ওঠা কী এতোই সহজ? এ তো কেবল একটি সন্তানের জন্ম নয়, একজন মায়েরও জন্ম! প্রথমবারের মতো যে মায়ের জন্ম হলো, সেতো এমনকী কীভাবে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হবে তাও জানে না! দুর্বল শরীরে নির্ঘুম রাত পার করার পাশাপাশি বিভিন্ন জনের হরেক রকমের আদেশ-উপদেশ-নির্দেশে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সদ্য জন্ম দেয়া একটি শিশুর মা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার সুযোগ অথবা সময় কোথায়! সেইসাথে সবাই ধরেই নেন, সন্তানের জন্ম দেয়ামাত্রই তাকে সন্তান পালনে পারদর্শী হতে হবে, কোনো রকমের ভুল মার্জনীয় নয়। সন্তান জন্মদানের পরপরই তার কাছ থেকে এতোটা প্রত্যাশা করা কি বাড়াবাড়ি না?

এমন তো হতেই পারে যে এইসন্তান গর্ভে নেয়ার সিদ্ধান্তে তার শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক প্রস্তুতি ছিল না! হতে পারে তার পড়ালেখার শেষ ধাপ পেরুনো তখনও বাকি ছিল! কিংবা চাকরির জায়গাটা সংকটময় ছিল! এমনকি সন্তানের জন্মের কারণে অনেক মায়েরই চুকে যায় পড়ালেখার পাট। অনেকেই প্রতিকূলতার মধ্যেও আকঁড়ে থাকেন চাকরি। চোখের নিমেষেই শেষ হয় মা হওয়ার ছুটি। বাচ্চার টীকা, অসুখবিসুখ অথবা স্কুলের তলব -সবটাতেই ছুটি নেবার অনিবার্য দায়িত্ব মায়ের উপরেই বর্তায়।

চাকরিতে বিরতি দিয়ে কিছুদিন বাড়িতে থাকার বিলাসিতা অনেক মায়ের পক্ষেই সম্ভব হয় না। হয়তো সংসার খরচের একটা বড় অংশই, তাকেই বইতে হয়। এতো কিছুর পরও মায়ের দায়িত্বে কমতি হওয়া চলবে না। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মা হিসেবে দায়িত্ব পালনে অবহেলার চোখ রাঙানি। অফিসে ছুটি চাইলে সহকর্মীদের ফিসফিসানি। সব মিলিয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে অপরাধী মা, তার অপরাধের মাশুল গুনেন নানাভাবে। অনেক অফিস-ফেরতা মা, সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দিতে পারার অপরাধবোধ থেকে প্রতিদিনই হাতে করে চকলেট বা খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরেন। নিজের অজান্তেই তিনি হয়তো সন্তানের মধ্যে তৈরি করেন অতিরিক্ত প্রত্যাশা।

যে সময় সন্তানকে ঘিরে দায়িত্বের ওজন বাড়তির দিকে যেতে থাকে, ক্যারিয়ারের জন্য সে সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার যুদ্ধে সেই সদ্য জন্ম নেয়া মায়েদের জন্য আমরা যদি একটু সংবেদনশীল হই!পরিবারের সদস্য হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে অথবা সহকর্মি হিসেবে। তাদের পথচলাকে একটু সহজ করার জন্য, আসুন তাদের পাশে দাঁড়াই। একজন সদ্য জন্মানো মা-কে পরিপূর্ণ একজন’মা’য়ে পরিণত হতে যার যার জায়গা থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াই।

শেয়ার করুন: