সাদিয়া রহমান:
মধুমিতা পাণ্ডের কাজ শুরু হয়েছিলো ভারতের সাড়া জাগানো “নির্ভয়া” গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কয়েকমাস পরেই একটা পরীক্ষামূলক প্রজেক্টের অংশ হিসেবে। নির্ভয়ার পরিচয় নতুন করে দেবার মতন কিছু নেই। নির্ভয়া সেই অকুতোভয় তরুণ মেয়েটি, যে ডাক্তার হওয়ার জন্য দিন গুনছিলো। সিনেমা দেখে বন্ধুর সাথে বাসায় ফেরার সময় যে গণধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনার শিকার হয়। এবং সাতদিন মৃত্যুর সাথে লড়ে শেষপর্যন্ত হার মানে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে নির্ভয়ার ঘটনা ভারতের আমজনতাকে রাস্তায় বের করে আনে। সরব করে তোলে বহুদিন ধরে চলে আসা এই ধর্ষকামী সমাজের বিরুদ্ধে। গবেষকেরা ভারতকে জি-২০ এর আওতাভুক্ত দেশগুলোর মাঝে, কঠোর পুরুষতান্ত্রিক দেশ সৌদি আরব থেকেও জঘন্যতম বলে ঘোষণা করে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে শুধু সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩৪,৬৫১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ভারতে।
ভারতীয় তথা এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে ধর্ষণ এখনও একটা ট্যাবু। কিন্তু নির্ভয়ার জন্য রাস্তায় নামা অগণিত মানুষের হুংকার এই ট্যাবুর বিরুদ্ধে একটা জাতীয় অবস্থান, জনমত গড়ে তোলে। মধুমিতা পাণ্ডে যিনি দিল্লিতে বড় হয়েছেন, এই ঘটনার পর নিজের শহরকে এক অন্য রূপে দেখতে পান। এবং এক অদ্ভুত কৌতুহল তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এই মানুষগুলোর ভিতরের কথা জানতে।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি কুখ্যাত তিহার জেলে তার থিসিসের জন্য কাজ শুরু করেন। বিগত তিন বছরে তিনি প্রায় শ’খানেক ধর্ষকের ইন্টারভিউ নিয়েছেন।
মধুমিতা আশ্চর্য হোন এটা ভেবে যে একজন মানুষ কীভাবে এমন একটা কাজ করতে পারে!
এই কৌতুহল থেকেই তিনি তিহার জেলে ধর্ষকদের সাথে কথা বলা শুরু করেন। তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, বেশিরভাগ ধর্ষকরাই অশিক্ষিত। মুষ্টিমেয় কতজন যারা হাইস্কুল পাশ এবং কিছু আছে যারা প্রাইমারিও শেষ করেনি। মধুমিতা বলেন, তিনি কাজ শুরু করেছিলেন ঠিক এই ভাবনা নিয়ে যে ধর্ষকেরা ইবলিশ, তারা মানুষ হতে পারে না। কিন্তু তিনি বিষ্ময় নিয়ে আবিষ্কার করছেন, এই মানুষগুলো নিতান্তই সাধারণ। এবং তাদের কর্ম নিতান্তই তাদের আজন্ম পাওয়া মানসিক শিক্ষা এবং লালন পালনের ফলাফল।
ভারতীয় রীতি অনুযায়ী এমনকি শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও নারীরা চিরকাল ধরে পালন করে আসা সাংসারিক কাজের ফ্রেমে বন্দী। এমনকি তারা তাদের স্বামীর নামটাও মুখে নেন না। মধুমিতা তার কিছু বন্ধুবান্ধবকে প্রশ্ন করে জেনেছেন তাদের মায়েরা তাদের বাবার নাম সবসময়ই উহ্য রাখেন। হয় ভাববাচ্যে কথা বলেন, অথবা “রওনাকের বাবা” অর্থাৎ সন্তানের বাবা হিসেবে ডাকেন।
এতে করে এদেশে পুরুষেরা পৌরুষ সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা লালন করছে। এবং নারীরাও প্রতিনিয়ত শুধু “নত মস্তকে”ই থাকতে শিখছে। মজার ব্যাপার হলো দুটো ঘটনাই একই ছাদের নিচে একই সময়ে পাশাপাশি ঘটছে। ধর্ষকদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, মানুষ ব্যাপারটাকে এভাবে দেখতে এবং দেখাতে পছন্দ করে যে, মজ্জাগত বা প্রকৃতিগতভাবেই ধর্ষকদের সমস্যা থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা ভিনগ্রহবাসী না। তারা আমাদের মাঝের, আমাদের সমাজেরই অংশ।
মধুমিতাকে সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে সেটা হলো তাদের বক্তব্যগুলো সমাজের আর অন্য সাধারণ মানুষদেরই মত। অনেক সময় হয়ত তার বাসাতেও সেই কথাগুলো বলা হয়। এবং একজন নারী হিসেবে আতংকের বিষয় হলো এই ধর্ষকদের সাথে কথা বলার সময় অনেকক্ষেত্রেই তাদের প্রতি সহানুভূতি জন্মায়। তিনি প্রায়ই ভুলে যেতেন যে, যার সাথে তিনি কথা বলছেন সে আসলে একজন ধর্ষক। আরো ভয়ংকর বিষয় হলো “সম্মতি” বলতে কী বুঝায়, তারা সেটি জানেই না এবং তারা এটাও জানে না, তারা যা করেছে সেটা ধর্ষণ এবং গর্হিত অপরাধ। অর্থাৎ ধর্ষণ ধারণাটার সাথেই তারা পরিচিত না।
এই অবস্থা এই প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দেয় যে, শুধু কি এই মানুষগুলোই এভাবে চিন্তা করে? নাকি বেশির ভাগ মানুষ আসলে এভাবেই চিন্তা করে?
ভারতীয় সামাজিক রীতিনীতি খুবই রক্ষণশীল। “সেক্স এডুকেশন” বা যৌন শিক্ষা পাঠ্যক্রম বহির্ভূত। কেননা নীতি নির্ধারকেরা মনে করেন এই ধরনের বিষয়বস্তু তারুণ্যকে কলুষিত করবে এবং ঐতিহ্যগত নীতিকে আঘাত করবে। মা বাবারা ছেলেমেয়েদের নিজেদের প্রজনন অঙ্গের নাম যেমন যোনি, শিশ্ন এসবের নামও শেখান না। ধর্ষণ, মিলন এসব কথা মুখে আনেন না। এইধরনের জড়তা না ভাঙলে আসলে কিভাবে উঠতি বয়সী ছেলেদের শিক্ষা দেয়া সম্ভব?
সাক্ষাতকারে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ধর্ষকই আত্মপক্ষ সমর্থন করে। এবং সেই আত্মপক্ষ সমর্থনের ধরনে বুঝা যায় তারা মনেই করে না তারা কোনো অপরাধ করেছে। অনেকে মনেই করে না যে, সে যেটা করেছে সেটাকে ধর্ষণ বলে। হাতে গোনা গুটিকয়েক অপরাধ বুঝতে পারে। বাকিরা যেভাবেই হোক তাদের কাজকে সঠিক বা নায্য মনে করে, এবং সেটা উপস্থাপন করে। দিনশেষে দোষটা ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ওপর চাপিয়ে দিয়ে হাত পা ঝাড়া হয়ে যায়।
এসবের মাঝেও বিশেষ একটা ঘটনা মধুমিতাকে অসম্ভব ধাক্কা দেয়। ৪৯ বছর বয়স্ক একজন অনুতাপ করে এইভেবে যে, সে ৫ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। তার অনুতাপের জায়গাটা ছিলো, বাচ্চাটি তার সতীত্ব হারিয়েছে এবং এই জন্য তাকে কেউ বিয়ে করবে না। এমনকি সেই ধর্ষক বের হয়ে বাচ্চাটিকে মেনে নিয়ে বিয়ে করার আশাও ব্যক্ত করে।
এই জাতীয় অনুতাপ তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। ধর্ষক তাকে সেই বাচ্চাটি সম্পর্কে সবকিছুই বলেছিলো। সে বের হয়ে বাচ্চাটিকে খুঁজে বের করে। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করে বাচ্চাটির পরিবারকে এটা জানানোই হয়নি যে অপরাধী জেলে আছে।
মধুমিতা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার গবেষণা এবং এর ফলাফল শীঘ্রই প্রকাশ করতে চান। তিনি বেশ হতাশা নিয়েই বলেন, সমাজ তার কাজ দেখার আগেই নারীবাদী ট্যাগ লাগিয়ে কাজকে অন্য চোখে দেখতে চায়। এই রকম পরিবেশে যেকোনো কাজই অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
(লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাদিয়া রহমান)