পরবাসী দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আপনি কে?

দিলশানা পারুল:

দেশ ছেড়েছি মোটে পাঁচ মাস, ওই জন্যই প্রবাসী, পরবাসী, অভিবাসী এই শব্দগুলোর সাথে এখনো ধাতস্থ হতে পারিনি। মনে হয় রাজশাহীর মানুষ যেমন ভালো থাকার জন্য ভালো কাজের জন্য ঢাকা আসে, ওই রকমই আমি এই দেশে এসেছি, টিকিট কাটলেই তো বাড়ি!

সত্যি বলতে এই অনলাইনের যুগে দেশ আলাদা করে মিসও করি না, কারণ মনে মাথায় মগজে দেশ গজা গেড়ে বসে আছে! বরং উল্টো, বাবা-মায়ের সাথে নিয়ম করে ছবিসহ কথা হয়, প্রতিদিনই কারো না কারো সাথে কথা হচ্ছে! আমার ছেলের দাদা-দাদীতো কম করে হলেও দিনে তিন বার ফোন করে।

না, আমি ঢাকা মিস করি না! বাংলাদেশ বলতে ঢাকা না! ঢাকায় আমার নাভিশ্বাস উঠে, প্রতিদিন চার ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকো শুধু কাজে যাবার জন্য, না ঢাকাকে আমি কোন কালেই ভালোবাসতে পারি নাই! ঢাকা আমার কাছে লাইফ সাকিং সিটি! আমি আমার জন্মস্থান জাহাঙ্গীরনগর মিস করি! আমি সবুজ মিস করি, গাছ, ফুল বৃষ্টি মিস করি! সে যখন ঢাকা থাকতাম, তখন আরো বেশি মিস করতাম। ঢাকা আমাকে ছাড়তেই হতো, বিদেশ না হলে রাজশাহী অথবা খুলনা!

সবাই ভালো থাকাটাই চায়, যোগ্যতা ছিলো, সেই যোগ্যতা বেচে বিদেশে পাড়ি জমালাম দক্ষ শ্রমিক হিসেবে! কম-বেশি বিদেশে যারা পাড়ি জমায়, আমার মতোই সবার এরকম একটা ছোট গল্প থাকে। কাছের দূরের বন্ধু, আত্মীয়, চেনা মানুষ, অচেনা মানুষ সমানে টিপ্পনি কাটলো দেশ নিয়ে এতো ভাবো, ঠিকই তো বিদেশে পাড়ি জমালা! তাইলে এতো বড় বড় দেশ প্রেমের বুলি আওড়াও কেন?

এ বড় অদ্ভুত দেশপ্রেমের সংজ্ঞা আপনাদের! দেশ প্রেম মানে বান্দরবন, রাঙামাটি বেড়াতে যাবেন, পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় দেখে, সবুজ দেখে বিমোহিত হবেন, আর গুন গুন করে গান গাইবেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” আর প্রমাণ হয়ে যাবে আপনি মারাত্মক দেশ প্রেমিক ! সবুজ বেলাভূমি চিরে ট্রেনে করে দেশের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেরাবেন, চাট খাবেন, আলু খাবেন আর গাইবেন “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা” আহ কী সাংঘাতিক দেশপ্রেমিক আপনি! আপনার দেশপ্রেম আপনাকে পাহাড়ে বেড়াতে যেতে শেখায়, অথচ শেখায় না যে পাহাড়ে মানুষ কাঁদে, তার পাশে দাঁড়াতে। আপনার দেশপ্রেম মানে চাষার চাষ করা আলু চাট খেয়ে চাষাকে চাষা বলে গালি দেয়া!

দেশপ্রেমে বিদগ্ধ হয়ে আপনি দরাজ গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাইবেন, দুইচার লাইন মারাত্মক দেশপ্রেমের কবিতাও হয়ত লিখে ফেলবেন, অথচ আপনার দেশপ্রেম আপনাকে শেখায় না যে চাষার চাষ করা চালের দাম কেন পড়ে গেলো সেইটা নিয়ে দুই লাইন কবিতা লিখি! বানের জলে ভেসে যাওয়া দেশের অস্তমিত সূর্যের মধ্যে আপনার দেশপ্রেম শিল্প খুঁজে পায়, অথচ দেখে না যে হাজার শিশু না খেয়ে রাত কাটায়! দিনের শেষে আপনার দেশপ্রেম শামীম ওসমান কিংবা ডিপজলের মতো প্রকাশ্য খুনিকে ভোট দিতে শেখায়।

এ কেমন ধারা দেশপ্রেম যেটা সুইস ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি দেশের টাকা লুট করে পাঠাতে বাধা দেয় না? এ কেমন ধারা দেশপ্রেম যেটা দেশের কৃষক শ্রমিকের সুখে দুখে তার পাশে দাঁড়াতে শেখায় না ? এ কেমন ধারা দেশপ্রেম যেইটা নিজের সন্তানের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রতিবাদ করতে শেখায় না? কী অদ্ভুত এক দেশ প্রেমের সংজ্ঞা আপনার ভাই মাইরি!

এই দেশে দুর্নীতি হয় বলা যাবে না, তাহলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপরাধে আপনার দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই দেশে শিশু ধর্ষণ হয় বলা যাবে না, এই দেশে মেয়েরা নিশ্চিন্তে রাস্তায় হাঁটতে পারে না বলা যাবে না, মন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলা সমস্ত যায়গায় দুই নাম্বারী, ক্ষমতার দম্ভ বলা যাবে না। বলা মাত্র আপনার দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমন সত্য বিবর্জিত, যুক্তিহীন ইলিউশনের দেশপ্রেম আমার লাগে না!

পরবাসী? কাকে আপনি পরবাসী বলেন? যেই ছেলেটা মধ্য প্রাচ্য থেকে হাতে ফোঁসকা ফেলে মা বাবার সংসার চালায়, তাকে? আপনার কি আসলেই ধারণা আছে পরবাসে বনবাসে কারা আসে? যেই মেয়েটা ফ্রান্সে অথবা ইউরোপে থেকে বোনের বিয়ে ঠ্যাকা দেয়, বাবার ভিটেতে একটা ইটের বাড়ি করে দেয় কিংবা বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাকে আপনি পরের দেশে বনবাসী বলে গালি দেবেন ? সে আপনার আমার কেউ না ? কোথায় পান এমন ঔদ্ধত্য? এই দেশেরই শিক্ষা ব্যবস্থায় তো? কোন সংস্কৃতি নিয়ে এতো অহংকার আপনার? যে সংস্কৃতি আপনাকে শিখিয়েছে চাষা একটি গালি ? চামার একটি গালি?

যে সংস্কৃতিতে নাপিত, কামার, কুমার, জোলা এইগুলা হলো সমাজে অচ্ছুত, সেই সংস্কৃতি? যেই সংস্কৃতিতে জোলার মেয়ে হলে বিয়ে হয় না সেই সংস্কৃতি নিয়ে এতো অহংকার আপনার ? যেই ব্যবস্থায় পিএইচডি করা শিক্ষকরা বুদ্ধি বেচেন হালির দরে, কবি সাহিত্যিকরা নীতি বেচেন কেজির দরে, সেই ব্যবস্থা নিয়ে এতো অহংকার আপনার?

দেশপ্রেম মানে বোবা কালা হয়ে থাকা না, দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হচ্ছে দেশের ভালোর জন্য নির্ভীকভাবে সত্যটাকে বলতে পারা, সেই সত্য তা যতো তিতাই হোক। দেশপ্রেম মানে দরাজ গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া না, দেশেপ্রেমের মানে দেশের সাধারণ মানুষকে ভালোবাসা, বিপদে আপদে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন। দেশপ্রেম কোন ইউটোপীয় ইলিউশন না, শিল্পীর আঁকা কোন এবস্ট্রাক্ট পিকচার না!
দেশপ্রেমের মানে খুব সহজ এবং সরল। দেশপ্রেমের মানে সুখে দুখে দেশের মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো, মানুষের সাথে, মানুষের হয়ে কাজ করা। মানুষ ছাড়া কোন দেশ হয় না। দেশের মানুষকে ভালোবাসা ছাড়া দেশপ্রেমেরও কোন অর্থ্ নাই।

শেয়ার করুন: