ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:
ফুরফুরে আমেজে ছুটির বিকেল।
রিকশার টুংটাং। গাড়ীর হর্ন।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ক্যাম্পাসের আড্ডাবাজিতে আগের মতো ঝড় কোথায়! আইফোন, হেডফোনে ব্যস্ত প্রেমিক – প্রেমিকারা। চোখে চোখ, হাতে হাত রাখার সময় নেই তাদের। পাশাপাশি বসে চোখ থাকে স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে, হাত থাকে কী-প্যাডে। অলওয়েজ অনলাইন!
আগেকার প্রেমে বাদামওয়ালার বিশেষ ভূমিকা থাকতো। সেসময় প্রেমিকার মন পেতে উদগ্রীব সব প্রেমিকেরই বাদামওয়ালার কাছ থেকে আলাদা করে ঝাল – লবণ আদায় আর ফুচকাওয়ালাকে – “অই মামু, এক্সট্রা টক দিও” বলে গলা উঁচানোর কমন দায়িত্ব ছিল। এখনকার প্রেমিক যুগলের কাছে বাদাম-বুট হয়তো “doesn’t make any sense!”
প্রেম মানে এখন ফেইসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, রেস্টুরেন্ট চেক – ইন, ব্র্যান্ড শপিং, রাতভর ভিডিও চ্যাটিং, দুদিন অন্তর ব্রেক-আপ সেলিব্রেশন!
ভালোবাসা, প্রতিবাদ , বিপ্লব – সবই যেন বড্ড সেকেলে শব্দ। ভালোবাসা মানেই কবিতা, গান, নাটক, প্রেমপত্র অবধারিত – সেদিন এখন অচল। একেই বোধ হয় বলে, “generation gap!”
পুরনো অনেক কিছুই নতুনদের কাছে অর্থহীন। বদলায়নি কেবল চায়ের দোকানের চিত্র। বিকেল থেকে মেশিনের মতো হাত চলছে চা বিক্রেতার। আদা চা, লাল চা, রঙ চা, দুধ চা, ঝাল চা, মশলা চা, মালটা চা, গুড়ের চা – ঝড়ের গতিতে চলছে।
রাজু ভাস্কর্য ঘিরে ছোটখাটো এক জটলা। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন হাতে রাস্তায় নেমে এসেছে এক দংগল নারী। কারো কারো সঙ্গে শিশু সন্তানেরাও শামিল। পুরুষও আছে তবে সংখ্যায় কম। অথচ ইস্যুটা যখন ধর্ষণ প্রতিরোধ,
অপরাধী যেখানে পুরুষ, তাদের নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসা উচিৎ ছিল।
হ্যাঁ, আজ ধর্ষণের মহামারী ঠেকাতে পথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে অবাধ্য নারীবাদ। মনে মনে আশা ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ, একটা বড় সমর্থন পাওয়া যাবে উপস্থিত ছাত্রদের কাছ থেকে।
আট মাসের শিশু থেকে শুরু করে কোনো বয়সের, যোগ্যতার বা কোনো অবস্থানের নারীই ধর্ষণের নোংরা থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, চলন্ত পথে সর্বত্র ঘাপটি মেরে আছে ধর্ষকামী পুরুষ। নারীর শরীর খুবলে খাওয়ার উন্মত্ত নেশা তাদের। নারীর রক্তমাংসের স্বাদ পাওয়া এই ড্রাকুলাদের সুযোগ হাতছাড়া করতে ভুল হচ্ছে না মোটেও।
ব্যানারে, ফেস্টুনে যে মেয়েগুলোর নাম লেখা থাকে, ছবি ছাপা হয় – শুধু ছবি তো নয় – একেকটা জলজ্যান্ত মানুষ ছিল তারা। সুন্দর পরিবার, আনন্দময় জীবন, স্বপ্নের পথচলা ছিল। কতগুলো দেহলোভী ইতর, ধর্ষক, খুনীর হাতে কী নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের! কী অসহায় মৃত্যু! সে মৃত্যু শুধুই প্রাণের নয় – একেকটি পরিবারের লালিত স্বপ্নের মৃত্যু, মানবতার মৃত্যু।
শিক্ষা, সভ্যতার উৎকর্ষতার এই যুগে, স্বাধীন একটি দেশে কীভাবে এতোটা অনিরাপদ, অরক্ষিত হতে পারে নারীর এগিয়ে চলার পথ?
রাজু চত্বরে প্রতিবাদ জানাতে আসা নারীদের দিকে সেদিন বহু মানুষই (!) তাকিয়েছে। ক্যাম্পাসে বসে, দাঁড়িয়ে, পথ চলতে, বন্ধুরা মিলে রিকশায় যেতে যেতে, সপরিবারে গাড়িতে চড়ে যাবার পথে – অনেক, অনেক মানুষই তাকিয়েছে। তাদের সেই অনেক, অনেক জোড়া চোখে ছিল এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। কারো বা চায়ের চুমুকে নির্বিকার চাহনি। কেউ কেউ হেসে হেসেই পাশ কাটিয়ে গেল। কোনো কোনো তরুণের দৃষ্টি আবার একে এক দল “বিগত যৌবনা”, “ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী” নারীর বাগাড়ম্বর ভেবেই বোধহয় ঈষৎ অবজ্ঞাসূচক কৌতুক প্রদর্শন করে গেল। এমন অনেক বাবাকে দেখা গেল যারা শিশুকন্যাকে পরম আদরে কোলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশে বসা কন্যার মায়ের চোখের তারা আনন্দে ঝিকমিক করছিলো। চিরচেনা এক চমৎকার দৃশ্য।
সেই স্নেহময় পিতা কী কখনো ভেবেছেন, পাঁচ বছর বয়সী পূজাও তার বাবা-মায়ের নয়নমণি? সেই ফুলের মতো শিশুটির ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছিল সেই ধর্ষক সাইফুলের বয়স ছিল পঞ্চান্ন! বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র, পথচারী, ব্যস্ত মানুষ কী সেদিন একবারও ভেবেছেন তনু,পূজা রূপার জায়গায় তার মা, জীবনসঙ্গী, কন্যা বা মেয়ে বন্ধুর কথা? প্রতিদিন পড়তে যাওয়া তার আদরের বোনটির কথা?
তারা সবাই নিরাপদে আছে তো? কাল কিংবা পরশুও থাকবে তো?
কোনো পুরুষ কী সেদিন লজ্জিত হয়েছে স্বজাতীয় ধর্ষকের জঘন্য অপরাধের কথা ভেবে?
ধর্ষক ভিনগ্রহ থেকে আসা প্রাণী না, সভ্য সমাজে বাস করেও নারীদেহের খোঁজে সদাসর্বদা ছোঁকছোঁক করে বেড়ানো কিছু অসভ্য পুরুষই ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে অহরহ। এদের রুখে দেবার দায়িত্ব কার? অবশ্যই রাষ্ট্রের, আইনের। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ – এসবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
পরিবারের দায়িত্ব সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়া, সচেতন করা, নারী- পুরুষের সমতার গুরুত্ব বোঝানো, বিবেকবোধ জাগ্রত করা, যেন কোনো কন্যাশিশুকে দৈহিক – মানসিক হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার না হতে হয়, কোনো পুত্রসন্তান ধর্ষক হতে না পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও বিশেষ দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। স্কুল পর্যায় থেকেই মেয়ে শিশুদের আত্মরক্ষায় জুডো, মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি। অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে বস্তাপচা, ভুল বার্তা বহন করা আত্মরক্ষার কৌশল অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।
সেই সাথে আমার এবং আপনার দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কারণ আমি, আপনি – আমরা কেউ পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করি না।
তরুণ প্রজন্ম একটি সমাজের, রাষ্ট্রের জন্য আশীর্বাদ। এও জানি, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার বিকল্প নেই। তাই বলে প্রযুক্তিনির্ভর, অথর্ব, নির্বিকার প্রজন্ম কাম্য নয় নিশ্চয়ই।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছাত্রজনতা যখন ধর্ষণের প্রতিবাদে শামিল হতে অনীহা প্রকাশ করে, সেসময় কবিতা, প্রেমপত্র, ল্যান্ডফোন আর ঘাসে বসে বাদাম চিবোনো প্রেমিক- প্রেমিকার যুগে জন্ম নেয়াটাকে বড্ড সৌভাগ্যের মনে হয়।
যে শিক্ষা, প্রযুক্তি আমাদের অনুভূতিহীন প্রেম শেখায়, অন্যায়ের প্রতিবাদে শামিল না হয়ে নির্লিপ্ত হতে শেখায় – Does it really make any sense?
প্রতিবারই ভাবি, আর একটি নতুন নামও যেন খবরে, ব্যানারে না উঠে আসে। ধর্ষকের বিচার হোক, ধর্ষণের বিলুপ্তি হোক।
কেউ শামিল হোক বা না হোক, প্রতিবাদ চলবে।