‘সংবিধান সাংঘর্ষিক’ বক্তব্যের জন্য শফীকে গ্রেপ্তারের দাবি

SEMC 3MP DSCউইমেন চ্যাপ্টার: হেফাজতে ইসলাম এর আমির আহমদ শফীর বহুল আলোচিত নারী বিষয়ক বক্তব্যকে ‘সংবিধান সাংঘর্ষিক’ উল্লেখ করে তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে এক সমাবেশে। ঢাকার শাহবাগে বিক্ষুব্ধ নারী সমাজের ব্যানারে ২০ জুলাই শনিবার বিকেলে এই সমাবেশ হয়।
বক্তারা শফীর এই বক্তব্যকে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা করে এর তীব্র সমালোচনা করেন। শফীকে ‘আহাম্মক শফী’ উল্লেখ করে তারা বলেন, এদেশের নারীরা যখন অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে, দেশের মোট বাৎসরিক আয় যখন ক্রমবর্ধমান, তখন সেই নারীকেই গৃহবন্দী করার প্রচেষ্টা মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটা ইস্যু।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে আহমদ শফীর বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, এই বক্তব্য আর হেফাজতের ১৩ দফায় নারী অধিকার খর্ব করার যেসব সুনির্দ্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এই বক্তব্য দেশের সংবিধান ও নারী উন্নয়ন নীতিমালা এবং সিডও সনদসহ নারী অধিকার রক্ষায় সকল সনদের পরিপন্থী। আরও বলা হয়, নারীর প্রতি নানা অত্যাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নারী অধিকার খর্ব করার, নারীকে অবদমিত করার, নারীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার ও নারীকে গৃহবন্দী করার। শফীর এই বক্তব্য তারই প্রতিচ্ছবি।
বিবৃতিতে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে হেফাজত, জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক দল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ এবং এদের সকল কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়।
নারীনেত্রী খুশী কবির বলেন, এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটাতেই নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। সুতরাং নারীকে এভাবে হেয় করার শাস্তি শফীকে পেতেই হবে। তিনি বলেন, কওমী মাদ্রাসা রেজিস্ট্রিকৃত নয়। হয় তাদের রেজিস্ট্রি করে আসতে হবে, নয়তো এটা বন্ধ করে দিতে হবে। মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে এনে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু মাদ্রাসা থেকে বেরোবার পরপরই চাকরি নিশ্চিত থাকে, কাজেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি নাগরিকের কর্মসংস্থানের বিষয়টি। এভাবেই নিরুৎসাহিত করা যাবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে।
তিনি আরও বলেন, হেফাজতের সৃষ্টিই হয়েছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে, ভাবতে হবে এর গূঢ় উদ্দেশ্যটা কি। যুদ্ধাপরাধীদের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা করে দেয়ার বিধানটিও রহিত করার আহ্বান জানান এই নারীনেত্রী।
মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী বলেন, শফীর বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। দেশের সংবিধানবিরোধী। কাজেই এটাকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।
ছাত্রনেতা জুনায়েদ সাকী বলেন, আওয়ামী লীগই হোক আর বিএনপিই হোক, সবাই ক্ষমতা চেনে। ক্ষমতার জন্য তারা ধর্মকেও ব্যবহার করতে পিছপা হয় না। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন বলেন, শফী তো সমাজে একা নন, এমন শফীর সংখ্যা অনেক। আর এধরনের নারীবিদ্বেষী বয়ানও এই প্রথম নয়, আগেও হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এই বক্তব্য ইউটিউবের কল্যাণে সবার কাছে চলে যাওয়ায় যে প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে, এটাও পজিটিভ। তবে শুধু নারীরাই কেন এর প্রতিবাদ করবে। নারীদের যখন বিভিন্ন ওয়াজে-বয়ানে সমালোচনা করা হয়, তখন পুরুষরাও কিন্তু বাদ যায় না। শফীর বক্তব্যেও তাই হয়েছে। পুরুষদেরও এখানে সমানভাবেই অপমান করা হয়েছে। কিন্তু পুরুষদের পক্ষ থেকে আজতক কোন জোরালো প্রতিবাদ করার কথা তো শোনা যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশপাশি শফীর মতো মৌলবাদীদেরও বিচার করতে হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে রাখার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যখন পথে-পথে ঘুরছি, তখন গোলাম আযমের মতো একজন আত্মস্বীকৃত রাজাকারকে সেখানে জামাই-আদরে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকারের এখনও চার-পাঁচ মাস মেয়াদ আছে। এরই মধ্যে এমন আইন করা হোক, যাতে কোন ফাঁকফোকর না দিয়েই যেন যুদ্ধাপরাধীরা বেরিয়ে যেতে না পারে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সম্মান দেওয়ারও আহ্বান জানান সরকারের প্রতি।
শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু বলেন, ‘শফী যেকথা বলেছে তা নতুন না। সাঈদীর মুখেও এমন কথা শোনা গেছে। তাহলে নারীরা কি করবে? তারা বসে থাকবে? নারীদের উচিত আরও এগিয়ে যাওয়া। ইতিহাসে নারীর যে বিপ্লবী ও সংগ্রামী ভূমিকা, তাই এগিয়ে নিয়ে যাবে নারীকে’। মিশু আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর মেয়েরা যখন সবজায়গায় তাদের প্রাধান্য বিস্তার করেছে, সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছে, তখন মেয়েদের ক্লাস ফোর/ফাইভ পর্যন্ত পড়ার ফতোয়া দেয়ার বিষয়টি মীমাংসা হতে হবে। তবে শফীদের কি হবে, সেটাও ঠিক করতে হবে। তিনি এধরনের কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পান বলে প্রশ্ন করেন মোশরেফা মিশু। পাশাপাশি এখনও তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না কেন, তা জানতে চান তিনি।
তিনি জানান, পোশাক শ্রমিকদের তিনি এই বয়ানের কথা বলেছিলেন। তারা তাকে বলেছে, শফীকে এতো পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। ওরা হলো তাদের শত্রু, তাদের চলার পথের বাধা। তাদের অগ্রযাত্রা এ ধরনের বয়ানে থামাতে পারবে না বলেও জানান পোশাক শ্রমিকরা।
মিশু আরো বলেন, শফীর বক্তব্য মানব ইতিহাস বিকাশের, সভ্যতা বিকাশের অন্তরায়। বাংলাদেশের অগ্রগতি ধরে রাখার লক্ষ্যেই এ ধরনের লোকেদের শাস্তি হওয়াটা জরুরি।
নারীনেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, শফীকে শুধু ঘৃণা জানিয়েই লাভ হবে না, এর পিছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্যও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় ছিল যখন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কথা বলতো ওরা, অপপ্রচার চালাতো। এখন নারীর পিছনে লেগেছে। তিনি বলেন, ‘নারী সম্পর্কে যা বলা হয় বুঝি, কিন্তু মাদ্রাসা-এতিমখানাগুলোতে যে ছেলেশিশুরা শিক্ষকের বলাৎকারের শিকার হয়, তাকে আমরা কি বলবো’? একজন স্বাভাবিক মানুষের আচরণ তো এটা না। তাছাড়া, একটি পক্ষ এখন শফীর বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গাইছে, এদের ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন রোকেয়া কবীর।
ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী ও গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধি লাকি আক্তার বলেন, আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞানী ব্যক্তি। কিন্তু কোনো জ্ঞানী মানুষ এধরনের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রাখতে পারে না। তিনি কি শুধু নারী সমাজকেই অপমান করেছেন? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে করেননি? এই যুগে এসে এমন পশ্চাৎপদ বক্তব্য আমরা গ্রহণ করতে পারি না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমতার রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান লাকি।

শেয়ার করুন: