বুকভরা ব্যাকুলতা নিয়ে ঘুরে ফিরে যে ফেরিওয়ালা…

মলি জেনান:

“ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।”

“আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড- পাহাড়-আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।”

আমি তসলিমা নাসরিনের কথা বলছি, যিনি বুকের মধ্যে বয়ে চলা ‘ব্রহ্মপুত্র’ নিয়ে ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। হৃদয় উজার করে ভালোবেসেও যিনি গোগ্রাসে লুফে নেন ভালোবাসাহীনতাও। নারীদের সকল যন্ত্রণা-দুঃখ-দুর্দশা-বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে, ধর্মীয় কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আজ যার একটা নিরাপদ বাসস্থান নেই, ঘর নেই, সংসার নেই, এমনকি দেশও নেই।

তিনি তাঁর লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা, মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ, নারীবাদ ও মানবাধিকারের প্রচার করতে গিয়ে একটি সহজ সাধারণ জীবনের নিরাপত্তা হারিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু হার মানেননি। যুগ যুগ ধরে সমাজের মননে-মগজে সিল এঁটে বসা পুরুষতন্ত্রের আগল খুলতে ঘর পেরিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তিনি; একা একলা হবেন জেনেও নারী’র জন্য সকল কুসংস্কারের আঁধার এবং শৃঙ্খল পেরিয়ে পথে নেমেছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর পাশে কাউকেই পাননি, না কোনো ব্যক্তি, না সংগঠন, কাউকে না। তবু শেকল ভাঙ্গার গান গেয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।

তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন-

‘তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।’

তসলিমা তখন মূলত ছিলেন কবি; কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যখন প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন, শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। তখন খবরের কাগজ খুব জনপ্রিয় কিছু ছিল না, কিন্তু তসলিমা নাসরিনের প্রবন্ধ ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। আর হবেই বা না কেন! যে কথা যুগ যুগ ধরে নারীরা লজ্জ্বা-ঘৃণা-শঙ্কায় নিজের মধ্যে চেপে রেখে বুকে এক বিশাল পর্বত তৈরি করে ফেলেছে, এই মেয়ে তা ভাঙ্গতে শুরু করেছে; আগে হয়তো অনেকেই চেষ্টা করেছে কিন্তু এমন আঘাত তো আর কেউ করেনি এই ধর্মান্ধ পুরুষ শাসিত সমাজকে। তিনি একের পর এক নারী অধিকার বিষয়ে লেখা শুরু করেন।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও সংবাদপত্রের কলামে নারীদের প্রতি সকল ধর্মীয়-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের কথা লেখায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করে। এই অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং মুক্তচিন্তার ঘেরাটোপে পুরুষতন্ত্রের আস্ফালন থেকে বেরিয়ে এসে আবার পথে নামেন একা একলা। আমাদের সমাজে পুরুষরা নারীকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখবে, স্ত্রী নামক দাসী রেখে পাশাপাশি আরো দশ-পাঁচটা সম্পর্ক অবলীলায় চালিয়ে যাবে,আর ব্রোথেল তো আছেই তাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু কোনো নারী আত্মসচেতন হয়ে উঠলেই সমস্যা, তাতে যে পুরুষতন্ত্রের অহমিকা আর অন্যায়ের রাজত্বে ভাটার টান চলে আসে।

তাই তসলিমা নাসরিনকে দেখি একা একলা কতোটা পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে। একা থাকা মানে সঙ্গীহীন হয়ে থাকা নয়, একা থাকা মানে স্বনির্ভর হয়ে থাকা। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া, নিজের আনন্দ নিজে খুঁজে নেওয়া। কোনও পুরুষের অভিভাবকত্ব না মানা। পুরুষকে সহযাত্রী ভাবা, বন্ধু ভাবা, অভিভাবক না ভাবা, প্রভু না ভাবা। এগুলো বলা সহজ হলেও একটা কট্টর পুরুষতান্ত্রিক আর ধর্মান্ধ সমাজে করা সোজা নয়। তিনি সেটাই করে দেখিয়েছিলেন।

তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘নির্বাচিত কলাম’ প্রকাশের পর তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। এই বইটি আমার, হয়তো আমার মতো আরো অনেকের বদ্ধ পুকুরের মতো স্থির-স্বচ্ছ জীবনে ব্যাপক নাড়া দেয়। এ তো আমার কথা, আমার মত, প্রতিটা নারীর জীবনের কথা, যা আমরা এতোদিন পাহাড়ের মতো নিজের বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম!

১৯৯৩ সালে ‘লজ্জা’ নামক তাঁর আরেকটি বহুল আলোচিত উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে রচিত একটি তথ্যবহুল উপন্যাস, যেখানে মুসলিমদের দ্বারা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা করা হয়। এই উপন্যাসটি প্রকাশের পর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁর ওপর শারীরিক আক্রমণ করে ও তাঁর এই উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানায়। এর প্রেক্ষিতে একজন লেখকের পাশে না দাঁড়িয়ে তাঁকে নিরাপত্তা না দিয়ে গ্রন্থমেলা কর্তৃপক্ষ নির্লজ্জভাবে তাঁকে মেলায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। যার ধারাবাহিকতায় আমরা হারিয়েছি, হারাচ্ছি হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিৎদের। যে অন্ধকারের চর্চা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ এ, তা আজ নিকষ কালো আধাঁরে রুপান্তরিত হয়েছে, এর কোনো শেষ নেই। একজন নারী সাহিত্যিকের উপর আক্রমণ ও নিষেধাজ্ঞাকে যারা গুরুত্বহীন বিষয় ভেবে মুচকি হেসে ছিলেন, তাঁরা এখন নিশ্চয় উপলব্ধি করছেন তা শুধু একজন নারী সাহিত্যিকের উপর আক্রমণ ছিল না, তা ছিল মূলত: মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চর্চার উপর আক্রমণ; যার ধারাবাহিকতা আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি।

তিনি নিজের কথা লেখেন এভাবেই-
‘কবিতা লিখি অল্প বয়স থেকেই। যতক্ষণ শুধু প্রেমের পদ্যে ছিলাম, ততক্ষণ আমি ভাল। আমার প্রতিবাদের গদ্য যত প্রখর হয়েছে, তত শুনেছি আমি মন্দ। শুনতে থাকি কুৎসা, নিন্দে, চরিত্রহনন। যে মেয়েকে বন্দি করা যায় না, যে মেয়ের নিজস্ব স্বর আছে, নিজস্ব ভাবনা আছে, তার বিরুদ্ধে এ সব ভাল জমে। এ নতুন কিছু নয়।’‘মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, কথা বলার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার – এসব অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উৎসাহ আমরা কোনও ধর্ম থেকে পাইনি, পেয়েছি শিক্ষিত সচেতন মানুষের তৈরি সভ্যতা থেকে।’

একা একলা একজন মানুষ গোটা ধর্মব্যবসায়ী ও পুরুষতন্ত্রের ভিত এমনভাবে নাড়িযে দিয়েছিলেন তাঁর লেখায় যে-১৯৯৪ সালের মে মাসে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাঁর ফাঁসির দাবি জানাতে শুরু করে। তিন লাখ মৌলবাদী একটি জমায়েতে তাঁকে ইসলামের অবমাননাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালরূপে অভিহিত করে। দেশজুড়ে তাঁর শাস্তির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তারি এড়াতে পরবর্তী দুই মাসে লুকিয়ে থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয় এবং তসলিমা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হোন।

দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরতে ঘুরতে দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষার পর ২০০০ সালে তিনি ভারতে প্রবেশ করার ভিসা পান। তাঁর দ্বিধাহীন সাহসী লেখার জন্য একসময় কলকাতার তথাকথিত মুক্তমনা লেখরাও তাঁকে তাদের জন্য হুমকি স্বরুপ দেখতে থাকেন। একে একে বাম-ডান-বুদ্ধিজীবী, ধর্ম ব্যবসায়ী সবাই তাঁর সাহসী কলমকে ভয় পেতে শুরু করেন। শুরু হয় তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর পাঁয়তারা। আবার তাকে নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি ও তথাকথিত দাঙ্গা। এই দাঙ্গার মুখে ২০০৮ এর ১৯শে মার্চ তিনি কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হোন।

যদিও দেশ তাঁকে বিতর্কিত করা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি, তবু তিনি বার বার থাকতে চেয়েছেন দেশের কাছে। দেশের মাটি ও মানুষের কাছে। তিনি বলতেন, কলকাতা তাঁর দ্বিতীয় দেশ, সেখানে তিনি বাংলাদেশের মাটি, মানুষ ও আবহাওয়ার স্পর্শ পান, অথচ সেখানেও তাকে থাকতে দেয়া হলো না। অবশেষে যেকোনো ভাবেই হোক ভারতেই থাকতে চেয়েছেন তিনি, নিজের দেশ-মাটিকে এমনভাবে ধারণ করেছিলেন যে, তার কাছাকাছি থাকাটাই তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল।

নারীর মুক্তি চেয়ে, ব্যক্তি স্বাধীনতা চেয়ে লিখতে গিয়ে তাঁর মতো আর কার জীবন এতোটা বিপন্ন হয়েছে? আর কে কবে এতোটা নির্বাসিত হয়েছে তাঁর মতো এমন? তবুও বার বার তিনি ফিরে আসতে চেয়েছেন এই মাটিতে, এই আলো হাওয়ায় তাঁর ব্রহ্মপুত্রের কাছে।

তিনি তাঁর ‘মেয়েটি’ কবিতায় লিখেছেন-

‘মেয়েটি একা,
মেয়েটি অসহ্য রকম একা, এরকমই সে একা,
এরকম নির্লিপ্তি আর জগতের সকল কিছুতে তার নিস্পৃহতা নিয়ে একা,
এভাবেই সে বেঁচে আছে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল নির্বাসনে।’

নারীবাদ নিয়েও তাঁর নিজস্ব ধারণা খুবই স্পষ্ট। তিনি বলেন-

‘নারীবাদের পথে ফুল নেই, কাঁটা আছে। নারীবাদ নিয়ে প্রচুর লোকের জ্বলুনি দেখেছি দেশে বিদেশে সর্বত্র। তারা বলতে চায়, তুমি মানবতন্ত্রে বিশ্বাস করো, ওটাই তো ভাল, নারীবাদী হওয়ার তো দরকার নেই। আমি বলি, যতদিন নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, ততোদিন নারীবাদকে টিকে থাকতে হবে। নারীবাদী আন্দোলন না থাকলে নারী আজ ভোট দিতে পারতো না, ভোটে দাঁড়ানোর কথা না হয় বাদই দিলাম। নারীবাদী আন্দোলন ছাড়া নারীর শিক্ষাও হতো না, স্বনির্ভরতাও হতো না, সমানাধিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। নারী এ পর্যন্ত যা কিছুই পেয়েছে, শ্রদ্ধা, সম্মান, স্বাধীনতা— সব কিছুই কিন্তু নারীবাদী আন্দোলনের ফলে। সে আন্দোলন নারী করুক বা পুরুষ করুক, বা উভয়ে মিলে করুক।’

তসলিমা নাসরিন, বড় অসময়ে অনেক আগেই জন্মেছেন আপনি। নারীর সমানাধিকারের কথা বলতে গিয়ে ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন বলে, জীবনে চলার পথে কাঁটা বেছেই আপনাকে পার হতে হলো। আমাদের সকল নারীদের নিজেকে চেনাতে, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়েছেন, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘুরতে হয়েছে ঘরহীন হয়ে। বই নিষিদ্ধ করা করেই ক্ষান্ত হয়নি কাপুরুষরা, বইয়ের প্রকাশক, ছবির পরিচালক আর পত্রিকার সম্পাদকদের আপনার চৌহদ্দি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় ভয় আপনাকে ধর্ম ব্যবসায়ী ও পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহকদের কারণ আপনার উত্থান ওদের সিংহাসনের ভিত নড়িয়ে দেয়। তারপরও তারা হেরে যায় আপনার ব্যক্তিসত্ত্বার কাছে। বহুদিন পরে আবার আপনার জন্মভূমিতে প্রিয় বইমেলায় আপনার বই আসে ‘শৃঙ্খল ভেঙেছি আমি’। আবার আপনার লেখাই আপনাকে আপনার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে অন্যভাবে।

আপনি যখন বলেন-

“আমাকে একা করে দেওয়া হয়েছে। শারীরিক আক্রমণ চলেছে আমার ওপর, আমি মানুষটাকে নিষিদ্ধ করেছে বইমেলা, সাহিত্য উৎসব। ভেঙে ফেলা হয়েছে আমাকে, টুকরো টুকরো করা হয়েছে আমার জগতকে। তারপরও উঠে দাঁড়িয়েছি। না, কেউ আমাকে সাহায্য করেনি কোনও গন্তব্যে যেতে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ আমার গন্তব্য। একটি হিংসাবিহীন পৃথিবী আমার গন্তব্য।

ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছি ভারতে। ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েদের তো বেশি জানি আমি, তারা তো আমারই মতো মেয়ে। আমারই মতো দেখতে, আমার ভাষার মতো ভাষা তাদের, আমার পূর্বনারীদের মতো তাদেরও পূর্বনারী, আমার ইতিহাসের মতো তাদেরও ইতিহাস, আমার মতো তারাও শিকার পুরুষতন্ত্রের, ঘৃণার, হিংসের, বিদ্বেষের— এই নির্যাতিত মেয়েদের যদি স্বাধীন এবং সাবলম্বী হতে এবং পাশাপাশি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে ওঠায় উৎসাহিত করতে পারি, তা হলেই আমার এই দীর্ঘ কণ্টকময় পথের যাত্রা সার্থক হবে।”

তখন বিশ্বাস করুন, আমরাও আবার ঘুরে দাঁড়াবার সাহস পাই; সামাজিকতা, লৌকিকতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বাতাবরণে থাকতে অভ্যস্ত এই আমরাও মানুষ হয়ে উঠবার প্রেরণা পাই। নিকষ আঁধার পথে সমস্ত অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে আসে এক টুকরো আলো। আমাদের বুকেও ঢেউ তুলে, কলকল রবে বয়ে যায় আপনার প্রিয়, প্রিয়তম ব্রহ্মপুত্র।

জন্মদিনে ঘরহীন, দেশহীন প্রিয় মানুষটিকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা! আপনি যেখানেই থাকুন, জ্বলতে থাকুন আমাদের অনেকের বাতিঘর হয়ে।

তসলিমা নাসরিনের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

(১৯৬২ সালের ২৫শে আগস্ট ব্রহ্মপুত্রের শহর ময়মনসিংহে তসলিমা নাসরিনের জন্ম হয়। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর পিতা রজব আলী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তসলিমার মা’র নাম ইদুল আরা। ১৯৭৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন, ১৯৭৮ সালে তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্য্ন্ত তিনি সরকারী গ্রামীণ হাসপাতালে এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্য্ন্ত মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিভাগে ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বেড়ে উঠা তসলিমা তেরো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময় তিনি সেঁজুতি নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন। কবিতার সূত্র ধরে ১৯৮২ সালে তসলিমা নাসরিন ও কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র পরিচয়-প্রণয় হয়, পরে তাঁরা পালিয়ে বিয়ে করেন। প্রেমিককে বিয়ে করে সুখের সংসার করতে গিয়েই তিনি বুঝতে পারেন এই সমাজে পুরুষতন্ত্র কতটা গভীরে শেকড় গেড়ে বসে আছে। আধুনিক, মুক্তমনা ও উদারচিন্তার কথাবলা মানুষও যে মননে মগজে পুরুষতন্ত্রের বীজ বহন করতে পারে ওই সংসারটি করবার সময়ই তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন সংসার হলো শুধুমাত্র নারীর মানিয়ে নেয়া, উজার করে দেয়া, পুরুষের স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে মেনে নিয়েই বশ্যতা স্বীকার করা।

এ বিষয়ে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন-
‘ওই সংসারটি করতে গিয়েই গোল বাঁধলো। দেখলাম আমিই প্রেম দিচ্ছি, আমিই উজাড় করে দিচ্ছি, বিনিময়ে যা পাচ্ছি তা হল স্বার্থপরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা। আমি তখন আমার পূর্ব নারীদের মতোই কোনও এক নারী। নির্যাতিত। তবে আমার পূর্বনারীরা যা পারেনি, তা আমি পেরেছি নিজের একনিষ্ঠতা, একগামিতা নিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।’

যাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন তাঁর পাশে থেকে হঠকারিতা সহ্য করে তাকে আরো নিচ হতে দেখতে চাননি বলেই নিজের সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি নিজেকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে দেননি, স্ব-মহিমায় এগিয়ে গেছেন।)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.