তাঁকে ঘৃণা করা যায়, মেরে ফেলা যায়, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না

ইশরাত জাহান ঊর্মি:

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়ে। তারও দু’এক বছর আগে নাওমি উলফ লিখে ফেলেছেন “দ্য বিউটি মিথ”, তারও বহু বছর আগে “রেপ যদি অনিবার্য হয় তো উপভোগ করো, তাতে কষ্ট কমে” ধরনের গগনবিদারী কথাবার্তা বলে দশদিক কাঁপিয়ে ফেলেছেন জ্যাঁ পল সাঁত্র’র প্রেমিকা, তারও বহুবছর আগে ওভারকোটের পকেটে পাথর ভরে লেকে ঝাঁপ দিয়েছেন ভার্জিনিয়া উলফ, তারও বহু বছর আগে শুলামিথ ফায়ারস্টোন নারীর “মা মা” বিষয়ক পবিত্রতাকে খারিজ করে দিয়েছেন।

সেসব খবর পৌঁছায়নি আমাদের গ্রামে। আমরা পিছিয়ে পড়া থানা শহরে বাস করি। আমাদের পড়াশোনা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত। বড়জোর বেগম রোকেয়ার সাথে ৮ই মার্চ লিংক করানো সরকারি অনুষ্ঠানে নজরুলের কবিতা আওড়ানো-…অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর…” তো সেইসময় আকস্মিকভাবে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়ে গেল।

১৯৯৪ সালে আমি যখন বালিকা থেকে তরুণীর শরীরে প্রবেশ করছি, কীভাবে ঢাকবো প্রবল হয়ে ওঠা শরীর-সেই চিন্তায় দিশেহারা। নিজের শরীরকে সবচেয়ে ঘৃণিত, ভয়ের আর লজ্জার মনে হয়। সারাক্ষণ আম্মুর রক্ত চক্ষু-ঠিক করে ওড়না পরো, ছেলেদের সাথে কথা বলবে না, খুব সাবধানে থাকবে-এইসব শুনে শুনে নিজের বাড়িও তখন অচেনা পৃথিবী।

সহপাঠী ছেলেরা চায়ের দোকানে বাইক রেখে তখন পংকজ স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া মেয়েদের শরীর মাপে, দু’একটা গানের কলি ভাঁজে, অথবা বলেই ফেলে “একেকটা কয় কেজি?”-এইসব শুনে শুনে এতো সবুজ আর মায়া মায়া থানা শহরটাও তখন অচেনা পৃথিবী। হঠাৎই মানুষ থেকে একলাফে ঊণমানুষ-মেয়েমানুষ হয়ে বড় সন্তর্পণে গোপনে বাঁচি। এই জীবন কোনদিন পৃথিবীর কোন পুরুষ যাপন করেনি। তারা কোনদিন এই জীবনের ঊণতার বোধ বুঝবে না। সেইসময় তাঁর সাথে দেখা। কপালে লেপ্টে যাওয়া টিপ পরা, ছোট করে কাটা চুল, সপ্রতিভ দুটি চোখ-আমার মনে হয় নামের বানানে একটা আ-কার বুঝি বাদ গেছে। ভুল করে পত্রিকা আর বই-এ তাসলিমা নাসরিন এর বদলে লেখা হচ্ছে তসলিমা নাসরিন। কদিনবাদেই সংশয়মুক্ত হই, না ভুল করে নয়,বাহুল্য আ-কার বাদে তাঁর নাম তসলিমা নাসরিনই।

তো তাঁর সাথে মানে তাঁর লেখার সাথে আমার দেখা হলো। এতদিন “নষ্ট মেয়ে” বলে একটা শব্দ যথাযথই আছে বলে জানলেও এই প্রথম স্পষ্ট জানলাম, “দুধ নষ্ট হয়, ডিম নষ্ট হয়, নারকেল নষ্ট হয় আর নষ্ট হয় মেয়ে। এই সমাজ দুধ, ডিম আর নারকেলের মতো খুব সহজে রায় দিয়ে দ্যায় মেয়েমানুষও নষ্ট হয়।”

আমাদের “বাংলার বধূ” “মায়ার সংসার” দেখা চোখ,”নারীর মন”পড়া মনন সমস্ত কিছু সুতীব্র এক ধাক্কা খেলো। আমরা ক্রমাগত বদলে যেতে থাকলাম। আমরা মানে হাতে গোনা দু’চারজন। আর যাদের বোধের বদ্ধ দরজা খুললো না তসলিমা নাসরিন নামটা তাদের কাছে ভয়ানক, নিষিদ্ধ, ক্ষতিকর একটা ব্যাপার হয়ে রইলো। আমরা হাতে গোনা কয়েকজন তারই নামে গাইলাম। গাইলাম কারণ আমরা যেন নতুন আমাদের পেলাম।

আমাদের একজীবন থেকে একটানে তুলে নিয়ে তিনি যেন পৌঁছে দিলেন অন্যজীবনে। নিজের শরীরটাকে তখন কম ভারী মনে হতে লাগলো,পুরুষ নামে প্রবল পরাক্রমশালী গোষ্ঠীকে আমরা হাতে গোনা কয়েকজন চ্যালেঞ্জ করতে থাকলাম। ও পথে কাঁটা ছিল খুব, সকলের ছি: ছি: ধ্বনি ছিল, কিন্তু আমরা মানুষ হওয়ার আনন্দটা পাচ্ছিলাম তখন। আমাদের এই আনন্দ আর কেউ দ্যায়নি, আমাদের এই বেদনা আর কেউ দ্যায়নি। আমরা যে পূর্ণ মানুষ-তার স্বাদ যেন আমাদের দিলো আমাদেরই মতো অন্য এক সাধারণ শহরের, আমাদেরই মতো সাধারণ পরিবারের একজন নারী। কেন জানি না তাকে আমাদের খুব আপন মনে হতে লাগলো। তাঁর মরে যাওয়া প্রেমিকের মতো মনে মনে সন্তর্পণে আমরাও তাঁকে “সকাল” বলে ডাকতে শুরু করলাম।

সেসব কোনও যুগের কথা। ধীরে ধীরে “তসলিমা নাসরিন” নামটি এদেশে ভয়ংকার ট্যাবু হয়ে গেল। অসম্ভব নারীবিদ্বেষী, নারীকে কোনমতেই মানুষ হিসেবে স্বীকার না করা এই সমাজ দেশছাড়া তসলিমার আগাপাশতলা বিচার করলো। সেই ঢেউ আজও বইছে সজোরেই। আজও তসলিমা নাসরিন মানেই একটা ভয়ংকর ট্যাঁবু। কোন একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীর আরও আরও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তার মতবাদ এদেশেও পাঠ্য হবে। ততদিন পর্যন্ত জীবিত তসলিমা নাসরিনকে ক্রমাগত পাথর মারা আমরা দেখে যাবো।

তসলিমা নাসরিন নারীর মুক্তি চেয়েছেন। একটা মাত্র জীবন মানুষের-এমনিতেই জন্ম থেকে চেইনড নারী-পুরুষ যাপন করতে পারে না নিজের ইচ্ছা মতো সেই জীবন, তারউপর শুধুই নারী হওয়ার কারণে নারীরা মার খাবে, ধর্ষিতা হবে, মারা যাবে-এই জিনিসটার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, দাঁড়িয়েছেন তিনি।

তাঁর জন্মদিন ২৫ আগস্ট। এই এতোদিন পরে তাঁর সম্পর্কে আমার যা মনে হয় তা হলো, তসলিমা নাসরিনকে গালি দেওয়া যায়, ঘৃণা করা যায়, সুযোগ পেলে কুপিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে খুনও করে ফেলা যায়। কিন্তু এই “জঘন্য” “মুরতাদ” মানুষটিকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না, সে মানুষটি মরুক বা বাঁচুক! এই এতোদিনে এইটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় অর্জন তাঁর।

শেয়ার করুন: