পুরুষের কাঁধে নারীর দায়িত্ব চাপানো সংকটজনক

শিল্পী জলি:

একবার চা বানাচ্ছি–
একজনকে চা দিতে গিয়ে দেখি তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। পাশের টেবিলে চা রেখে বললাম, আপনার চা। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন আমি কেন তার ঘুম ভাঙালাম–তাকে মেরে ফেলতে চাই নাকি? একে তার ঘুম হয় না তথাপি আমি ঘুম ভাঙালাম– উদ্দেশ্য কী? যদিও একটু আগেই তিনি তাকিয়েছিলেন।
বুঝলাম, ভুল করে ফেলেছি, পরের বার সাবধান হতে হবে। 

আবার চা বানাচ্ছি–
দিতে গিয়ে দেখি উক্ত ব্যক্তির চোখ আবার বন্ধ। শব্দ না করে চা’টি তার পাশের টেবিলে রেখে দিলাম ঢেকে।
এবার তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমি কী ভিক্ষুক যে আমাকে চা দিয়ে বলবে না !’
বুঝলাম, দোষ ধরতে চাইলে এমন হাজারটা দোষ ধরা যায় একজন মানুষের।

মাঝে মাঝে লেখালেখি করতে বা পড়তে গিয়ে দেখি অতি সাধারণ এবং নিরপেক্ষ কিছু যৌক্তিক লেখাতেও পুরুষ সমাজের কিছু জনতা ক্ষেপে ওঠেন। ক্ষেপে উল্টাপাল্টা হাবিজাবি কথা বলতে থাকেন অথচ কেন যে ক্ষেপলেন বোঝা দায়।

সম্প্রতি, আমার এক লেখাতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে একজন বলেছে, আটত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে মেয়েদের মেনোপজ হয়ে যায়, তাদের শরীর আর বিক্রি হয় না, ফলে তারা লেখালেখি করে নারীবাদী হয়ে ওঠে!’ সাথে আরও রকমারি অকেজো বাজে কথাও যুক্ত করেছে। তার মন্তব্যই পুরো একটি লেখা হতে পারে, এতো বড়।
উক্ত ব্যক্তির প্রোফাইল পিকচারে তার কোন ছবি নেই। সেই দেখে বললাম, যে ব্যক্তি প্রোফাইলে ছবি দেবার সাহস করে না তার এত বড় বড় কথা কিসের?
উওরে জানালেন, ‘আমার একটি প্রোফাইল পিকচারই নাকি তাদের এটা ওটা সব ঘটিয়ে দিতে যথেষ্ট এবং আমি তা সব ভালো করেই জানি !’
ভাবলাম, তাহলেতো জনাবের জন্যে এটা বড়ই দুঃসময়! সামান্য একটি ইউকাট গলার গেঞ্জি পরা ছবি দেখলেই যদি একজন পুরুষের সব কিছু ঘটে যায় তাহলে বাস্তবে কী দশা হবে তার ?
সব রাগ, অভিমান, কটুকথা ভুলে গিয়ে তাকে বললাম, এমন হলেতো অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো জরুরি !
কী বুঝলেন বুঝলাম না। তবে কমেন্টটি ডিলিট করে দিয়েছেন তৎক্ষণাৎ।
হয়তো মেয়ে দেখে ঘা দিতে এসে আতে উল্টা ঘা লেগেছে ।
অথচ একটু আগেই লিখেছিলেন, আমাদের মতো নারীবাদীদের নাকি পড়ালেখা নেই, শরীর বেচে খাই এবং এখন নাকি শরীরও আর বিক্রি হচ্ছে না–মেনোপজ ধরে গিয়েছে ! 

শরীর কি তাদেরও আজীবন ঠিক থাকে?
নারীর মেনোপজ বা যেই পজই হোক, চাইলে একজন নারী আজীবন এক পুরুষের মাঝেই তার আকর্ষণ ধরে রাখতে পারেন। যৌনতার কন্ট্রোলও তার নিজের কন্ট্রোলে–যখন তখন মাথাচাড়া দেয় না। পুরুষের তো বিয়ে একটু পুরোনো হলেই উত্তেজনা অনুভব করতে কম বয়সী রকমারি নারীর পেছনে ছুটতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে–সেখানে নারীকে এতো অবজ্ঞা কেন ? নারীর মেনোপজকেও কি চ্যালেঞ্জ করা যায়?
পঞ্চাশ/ষাট বছরের নারীর পেছনেও কি পুরুষ ছোটে না?

তাদের এ ধরনের অকেজো লেখাগুলো পড়লে মনে হয় একজন নারীর জীবনে বুক এবং পাছুই সব। উক্ত দুই অংশ পেঁচিয়ে, মুড়িয়ে সমতল করে রাখাই তার জীবনের একমাত্র ধর্ম, আর কিছু করতে হবে না তাকে। যেনো বুক-হিপ এবং অনুমোদিত যৌনতাই নারীর জীবনের পুরো বাইবেল। নারী মানে শুধু সেক্স ভাবনা– তাকে একজন অনুমোদিত পুরুষের জন্যে সেভাবে তৈরী থাকতে হবে, এবং সেভাবেই পুরো জীবন পার করতে হবে যেন কোন আলোর মুখ আর সে না দেখে। জীবন বুঝবে না, জগৎও বুঝবে না।
আসলেই কী এভাবে জীবন চালানো সম্ভব ?
একজন পুরুষ কী আসলে ততটা শক্তিশালী যে একজন নারীর পুরো জীবনের ভার আজীবন নিজের কাঁধে বইতে সক্ষম?
নাকি তাদের মাঝে তীব্র এক ভীতি কাজ করে তাদেরকে অবিরত অস্হির করে তোলে, যদি তার নারীটি কখনও হাতছাড়া হয়ে যায়? তাই ‘নারীবাদী’র মতো একটি সম্মানজনক শব্দকেও তারা গালির সমার্থক শব্দ হিসেবে প্রচারণা চালান যদিও শব্দটি মূলত ‘সমতার’ বার্তা বহন করে!

আসলে একটি সমাজের নারীবাদীরা কতটা ভয়ঙ্কর?
নাকি তাদের আত্মনির্ভরশীলতাই একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্যে ভীতিকর?
নাকি তাদের সরবতা?

সম্প্রতি তসলিমা নাসরিনকে ভারতের মতো একটি দেশেও অজন্তা-ইলোরা দেখতে বাদ সাধতে কাজকর্ম বাদ দিয়ে পাঁচ’শজন পুরুষকে ভীড় জমাতে দেখা গেলো!
যেই নারীর নিজের দেশই নিজের নয়, পৃথিবীতে একটি দেশকেও যাঁর নিজের বলার উপায় নেই, তাঁকে ঠেকাতে পাঁচ’শ পুরুষের এফোর্ট দেয়া, কেন?
ভয় কিসের?
যদিও পটর পটর লেখেন, তিনি কিন্তু কথা বলেন শান্ত এবং কোমল স্বরে। এবং স্ব-ঘোষিত নাস্তিক এবং নারীবাদী তিনি!

মানুষের আস্তিকতা এবং নাস্তিকতার হিসেব পরকালের– এই হিসেব নিকেষে ফেরেশতারাই যথেষ্ট , তাই আর ওদিকে যাবো না। বরং তাঁর নারীবাদী চরিত্রের দু’ একটি দিক নিয়ে কথা বলি–
অনেক পুরুষের দৃষ্টিতেই তিনি একজন বাঘা নারীবাদী।
সেই বাঘা নারীবাদী মেয়েটিও রুদ্র’র মতো একজন অতি সাধারণ পুরুষকে ভালোবেসে বিভোর হয়েছিলেন। অর্থাৎ নারীবাদীরাও পুরুষকে ভালোবাসতে জানেন।
আরও জানা যায় তাঁর আপন ভাইরা তাঁকে সম্পত্তির ভাগে ভালোমতোই বঞ্চিত করেছেন–অর্থাৎ নারীবাদীরাও স্বার্থরক্ষায় কাঁচা হয়।
মাঝে মাঝেই দেখা যায় তিনি নিজ হাতে রকমারি রান্না করে অতিথি (নারী-পুরুষ) আপ্যায়নে ব্যস্ত। তাহলে বলা যায়, নারীবাদী মানেই পুরুষের ক্ষতি নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই লাভ।অন্য কথায় এক্সট্রা সামাজিক, মানসিক, এবং আর্থিক সাপোর্ট পাশে পাওয়া !

যাইহোক, কে লিখে নিজেকে নারীবাদী হিসেবে জাহির করলেন সেটিই কি বড় কথা?
মানুষের কর্মই কি বলে দেয় না সে আসলে কোন মতে বিশ্বাসী?
কতটা স্বনির্ভর তার পথ চলা?
কতটা সমতায় বিশ্বাসী তিনি?

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরবাসী শেখ হাসিনা জানের পরোয়া না করে যেভাবে দাপটের সাথে ঘুরে দাঁড়ালেন, প্রধানমন্ত্রী হলেন, পরিবার হত্যার বিচার করলেন, এবং নিজের পুত্র এবং পরিবারের জন্যে রাজনীতির পথ সুগম করে তুললেন তাঁকে কী আর তথাকথিত অবলা নারী হিসেবে চিন্হিত করার উপায় আছে ?
নাকি বলা যায় তিনি তাঁর পরিবারের জন্যে যথেষ্ট কাজের নন ?
পিতার পর তিনি তাঁর পরিবারের জন্যে যতটা করতে পেরেছেন হয়তো তাঁর পরিবারের অন্য কেউ ঐ পরিস্হিতিতে সেটা করার সাহসই করতে পারতেন না!
তিনি নিজেকে নারীবাদী বলে বলে মুখে ফেনা না তুলে ফেললেও তিনি যে একজন পুরুষের চেয়েও বেশী নারীর কর্মে বিশ্বাসী, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার মাঝে মাঝে পরিবারের জন্যেও রাঁধেন তিনি নিজ হাতেই। তাহলে এতে পুরুষের ক্ষতি কোথায়?

হুমায়ূন আহমেদের মা-ও নিঃস্ব অবস্হায় বিধবা হয়ে প্রতিটি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। বৈরী পরিবেশেও হাল ছাড়েননি। তাঁকে কি বলা যায় ঘরকোণা নারী, ক্ষমতাহীন?
হুমায়ূন বিধবা অল্প বয়সী শাওন দাপটের সাথে তাঁর দু’সন্তানকে মানুষ করে যাচ্ছেন–
যদি তিনি দুজন শিশু নিয়ে এই সমাজে অবলা হয়ে থাকতেন, তাহলে আজ তার পথচলা কেমন হতো? কতভাবে হেনস্তা হতে হতো তাকে?
এই সন্তানরাই বা তখন কেমন থাকতো?

আমার এক ঘনিষ্ঠজন এক সময় হাসপাতালের রোগী দেখতে গেলে নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। কেন এভাবে জ্ঞান হারায় জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, শত শত লোক ওভাবে শুয়ে আছেন দেখলেই তার খবর হয়ে যায়, চক্কর খায় মাথা। প্রথম জীবনে বাবা-মায়ের অতি আদরে বড় হয় সে। পরের জীবনে অতি আদর নিয়ে বরও এসে হাত বাড়ায়। কিন্তু হঠাৎ কান্সারে আক্রান্ত হয়ে বর প্রাণ হারান। বর্তমানে বাবা-মাও নেই, বরও। তদুপরি একটি সন্তান অসুস্হ। এখন সন্তানসহ নিজের ভার বইবার পুরো দায়িত্ব তার একার কাঁধে, যে কিনা একা কোনদিন পথ চলেনি!

আসলে একজন নারী স্ব-নির্ভর এবং স্বাধীন হলে লাভ কার?
কে এবং কারা তখন নিরাপদ থাকে?
আমাদের সমাজের পুরুষরা কী সে কথা সহজে বোঝেন?
নাকি নারীকে শুধু দমিয়ে রাখাতেই তাদের যত তুষ্টি?

পরিচিতা একজন স্ত্রী বলে বলে তার বরকে পিএইচডি করিয়েছিলেন। দেবর-ননদকেও বাসায় রেখে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বর পিএইচডি করেছেন আর বছর ভরে অবিরত রাগ দেখিয়েছেন–পিএইচডি করতে চান না, বউয়ের চাপে পড়ে করতে হচ্ছে! অবশেষে পিএইচডি শেষ। উৎসর্গ করলেন নিজের মায়ের নামে–বউয়ের নাম গন্ধটিও কোথাও নেই। যদিও কর্মের স্বীকৃতি জোটেনি মেয়েটির তবুও আছেন তার পরিবারের পাশে, তাদের স্বার্থে।

বলতে গেলে প্রতিটি নারীই এমন করে সাধ্যমতো পুরুষের পাশে হাল ধরে থাকেন। এক্সট্রা শক্তি হয়ে পথ চলতে সহায়তা করেন। হিলারি ক্লিনটন, মিশেইল ওবামা থেকে শুরু করে আমাদের আলীপুরের গাছি শুকুর আলীর বউ কারও অবদানই অস্বীকার করার উপায় নেই তাদের পুরুষটির জীবনে।

শুধু পার্থক্য এটুকু যে এই নারীদের সবার পথচলা, চ্যালেঞ্জগুলো এক রকম নয়, সুবিধাগুলো সমান নয়! বিশ্বাস করা হয় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং ওবামার মতো ক্ষমতাধর উক্ত দুই পুরুষের জীবনে উক্ত দুই নারী ভালোবাসা, সাপোর্ট এবং প্রজ্ঞা নিয়ে না দাঁড়ালে তাঁরা হয়তো কখনও ঐ অবস্হানে যেতে পারতেন না।

আমাদের মত দেশে প্রতিটি নারীকেই তাঁর অবস্হানে থেকে অবিরত ফাইট করতে হয়। পাশাপাশি সমাজ পিছিয়ে থাকলে সম্ভ্রম রক্ষা করা তার জীবনে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। তথাপি ঘরে ঘরে পুরুষও বিপদে পড়লে যখন তখন তার নারীর কাছে সহযোগিতা খোঁজেন, অপারগতা জানান , বা নিজের দায় চাপিয়ে দিয়ে বলে বসেন, আর পারবো না যেমন করে পারো চালাও তোমার সংসার। হয়তো হাতে ধরিয়ে দেন মাত্র কয়েক হাজার টাকা। কখনওবা অকস্মাৎ কোন রোগবালাই বা মৃত্যু এসেও নারীর কাঁধে সংসারের দায় চাপিয়ে দেয় বাধ্যতামূলকভাবে। তখন উপায়হীন নারীটিকেই খুঁজে বের করতে হয় একটি পথ, তার পরিবার এবং সন্তানদের কথা ভেবে। ধর্ম বা নারী হবার অজুহাত নিয়ে তখন আর চুপচাপ ঘরে বসে থাকার উপায় থাকে না। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে তখন ডাবল কষ্ট নিয়ে পথ চলতে হয় নারীর। অপশন কম থাকে, এবং জীবনের অনঅভিজ্ঞতাগুলো এসে গতিরোধ করে বার বার সামনে দাঁড়ায়।

পরিবার, পুরুষ, এবং সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই একজন নারীর স্ব-নির্ভর হওয়া জরুরি। লিঙ্গ ভুলে মানুষে মানুষে সমতা এবং কর্মে বিশ্বাস করা জরুরি। তাহলে সে যেমন সময় থাকতে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে তেমনি প্রয়োজনে নিরাপদ থেকে পরিবারকেও সাপোর্ট করতে সক্ষম হয়। আবার অভিজ্ঞতা থাকায় হোঁচটও কম খেতে হয় তখন।

সামাজিক প্রথা মতে একজন পুরুষের কাঁধে নারীর বোঝা চাপানো হলেও এটা নিশ্চিত করতে পারে না, এই পৃথিবীতে কে কতদিনের মেহমান ?
আজীবন কে কার ভার বইবে? তদুপরি, সমাজে ডিভোর্সও জায়েজ। অতএব লিঙ্গ ভুলে প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ পদে এবং কাঁধে নিজের ভার বহন করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ, নিরাপদ এবং যুক্তিসঙ্গত।

অন্য কথায় বলা যায়, মানুষের সমতায় বিশ্বাস করাতেই জাতির আসল মুক্তি।

শেয়ার করুন: