আপনি শুধু মা নন, একজন মানুষও

হাসিন জাহান:

যখনই মায়ের প্রসঙ্গ আসে – তা সে স্মৃতি রোমন্থনেই হোক, নাটকের চরিত্রেই হোক, বা মা দিবসের কোনো টিভিসিতেই হোক- প্রকাশের ধরন অধিকাংশ সময় একই রকম। মা মানেই সাদা বা ধূসর রঙের সুতি শাড়ি পরা সর্বংসহা এক নারীর প্রতিচ্ছবি। যাঁর প্রধান কাজ – নিজে না খেয়ে মিথ্যে বলে নিজের ভাগের বরাদ্দ খাবারটি সন্তানের পাতে তুলে দেয়া, যার রান্না অসম্ভব রকম মজা (mother is the best cook)।

তাঁর দৈনন্দিন সকল কাজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো: কিছুক্ষণ পর পর সন্তানদের ফোন করে খবরাখবর নেয়া, আর মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থেকে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করা, এবং সে ফিরলে তাকে খাবার গরম করে খাওয়ানো। আরো কিছু অনুষঙ্গ আছে- বারবার ফোন করার পরও, পরিস্থিতির কারণে, সন্তান যদি মায়ের ফোন না ধরে বা বাইরে থেকে খেয়ে আসে তবে মায়ের জীবন প্রায় বৃথা।

আর এসবকিছুর সাথে যদি ছেলের বউ থাকে, তবে তো তা বিরাট অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। মাঝে-মধ্যে আমার খুব সহজ কিছু প্রশ্ন মনে জাগে – মাকে শুধু হালকা রঙের সুতি শাড়িই পরতে হবে কেন? সব মাকেই কেন “মাস্টার শেফ” হতে হবে? কাজের ধরন বুঝে সময় অনুযায়ী ফোন করলে বা ফোনের বদলে টেক্সট করলে অসুবিধা কী?

সহজলভ্য (সবার জন্য না) মাইক্রোওয়েভ ওভেন থাকতে খাবার গরম করার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করারই বা কী দরকার? মায়েরাও তো মানুষ। তাদের রঙিন কাপড় পরতে বাধা কোথায়? সুস্বাদু রান্না করতে পারাই কি তাদের জীবনের লক্ষ্য? মাঝে মাঝে ভাবি, “ভালো” মায়ের কোনো স্মৃতিই তো সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারলাম না! তারা আমাকে সারা জীবন বাসায় পায়জামা-শার্ট ছাড়া কিছু পরতে দেখলো না। বরং প্রায়ই দেখা যায়, কাছাকাছি রকমের হওয়ায় আমার পায়জামার সাথে ওদেরটা অদল-বদল হয়ে যায়!

রান্নার অবস্থা তো ভয়াবহ। মাঝে-মধ্যে রান্না করার চেষ্টা করলে বড়টা তো খাওয়ার আগ্রহই দেখায় না, আর ছোটটা নীরবে খেয়ে সান্তনা দিয়ে বলে, “সবাই তো সবকিছু পারে না, তুমি না হয় এই কাজটা নাই পারলে!”

ঘরে-বাইরে কাজের চাপে, ছোটবেলায় খাবারের প্লেট নিয়ে ওদেরকে খাওয়ানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ছোটাছুটি করি নাই। জানতাম ক্ষিদে পেলে নিজেরাই খেয়ে নিবে। ম্যাটার্নিটি লিভের মুখ দেখি নাই। বাচ্চার দুই মাস থেকে বয়সে ট্যুরে যাওয়া শুরু করতে হয়েছে। বাচ্চার স্কুলের সামনে বসে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি নাই। প্রতিদিন হোমওয়ার্কের তাড়া দিয়ে মাতৃত্ব প্রমাণ করতে পারি নাই। ওরা স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে থাকতে, পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে কিরা-কসম কেটে, নাওয়া-খাওয়া ছাড়ি নাই। শুধু শর্ত দিয়েছি, এক ক্লাসে দুবার পড়ানোর সামর্থ্য আমার নাই, সুতরাং রেজাল্ট যাই হোক, পাশ এক দফাতেই করতে হবে! শেখানোর ক্ষেত্রে ছোটবেলায় সেই অক্ষরজ্ঞান আর বড়বেলায় বিভিন্ন ফরম পূরণ (ভর্তি, পাসপোর্ট. ব্যাংকের হিসেব খোলা) করতে শিখিয়েছি।

ব্যস, এটুকুই মনে পড়ে। আসলে মায়েদেরও সময় বদলেছে, ভাবনা বদলেছে। একটা মেয়ে যখন পড়া শেষ করে, তখন তাকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে অনেকগুলো ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যেমন, নতুন চাকরি, কর্মজীবনে প্রবেশ, নিজেকে খাপ খাওয়ানো এবং অনেকক্ষেত্রেই মেয়ে হবার কারণে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে অনেক বাড়তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় একই সময় তাকে বিয়ে, নতুন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেয়া, নতুন সংসার সামলে চাকরিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হিমশিম খেতে হয়। তারপরে আবার যদি কোনো মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে থেকে তার কর্ম ও পারিবারিক জীবনের যৌথ সূচনা করতে হয়, তবে তো অবস্থা আরো সঙ্গীন!

বউয়ের চাকরি করা কতোটা জরুরি? আপনার বেতন সংসারের জন্য যতই প্রয়োজন হোক না কেন, আপনাকে যে চাকরি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, এটাই কি যথেষ্ট না?

আরও আছে- অফিস ছুটির পরে দেরি হয় কেন? এতো ম্যাচিং- সাজগোজের দরকার কী? অফিসের কাজে ট্যুরে কেন? সাথে কে যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? তার সাথে সম্পর্ক কী? অফিসের কাজ বাসায় সাথে করে নিয়ে আসা! নৈব নৈব চ … অথচ চাকরির শুরুটাই একটা ক্রান্তিকাল। তখন নিজের ইচ্ছায় অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া সম্ভব না। জরুরি কাজে হয়তো পরের দিনই আপনাকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। এই কথাটা বাড়ি ফিরে জানানো মাত্র কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভেবে হয়তো আপনার মুখটা কালো হয়ে গেল।

অথবা, আপনার পিরিয়ড চলছে। এতো দূরে যাওয়াটা কষ্টকর হবে। এর কোনটাই আপনার পক্ষে বলা সম্ভব না। কারণ আপনার ক্যারিয়ার তৈরির এটাই সময়, নয়তো প্রতিযোগিতায় আপনাকে পিছিয়ে পড়তে হবে। হয়তো আপনার সহকর্মীরাই বলবেন, মেয়ে হিসেবে বাড়তি সুবিধে নিচ্ছেন। এমনই একটি প্রশ্নবিদ্ধ জীবনের মোহনায় এসে যখন আপনি মা হলেন, তখন তো আরেক মহাকাব্য!

বাচ্চার অসুখ?

মা হিসেবে আপনারই ছুটি নিতে হবে, হোক না পরের দিন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং অথবা সেমিনারে আপনার উপস্থাপনা। তাতে কী? মা হিসেবে দায়িত্ব তো আপনারই! টিফিনে প্রতিদিন কী খাবে? ভাবুন। সন্তান তো আপনারই। পরীক্ষায় নাম্বার কম পেয়েছে? আপনি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমনই তো হবে! সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনার দায়ভারও বাড়তে থাকবে। বাবার অগোচরে তাদের শখ, আপনার সাধ্যের মধ্যেই ম্যানেজ করতে হবে।

এক সময় দেখা যাবে নিজের পছন্দ মেটানোর সুযোগ আর ইচ্ছা দুটোই খুব সীমিত হয়ে গেছে। কারণ আপনি মা। তাই আপনার দায়িত্ব অন্যের প্রয়োজন মেটানো। এর মাঝে সন্তানরা বড় হবে, কর্মক্ষম হবে, সমাজে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে কখনো-সখনো আপনার নামেরও ব্যবহার হবে। তবে হ্যাঁ, যদি তারা কোনভাবেও পথভ্রষ্ট হয়, তবে সেই কলংকের দায়ও কিন্তু মায়েরই। অথচ একজন মায়ের গর্ভধারণের কষ্ট অথবা প্রসব যন্ত্রণা কি কোনো সন্তানের জন্যই কম হয়?

জীবন একটাই। মা হিসেবে নিজের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে শেষ বয়সে এসে মলিন চেহারা নিয়ে খাবার গরম করা অথবা মা দিবসের কেক কাটার সেল্ফিতে সন্তানের টাইমলাইন আলোকিত করার পাশাপাশি নিজের ভালো লাগার বিষয়গুলোও তাদেরকে জানতে দিন।

তার চেয়েও জরুরি হলো – আপনি নিজেই নিজের ইচ্ছেগুলোর মূল্য দিন। নিজের ভালোলাগা, পছন্দ ও প্রয়োজনগুলি পূরণ করার চেষ্টা করুন। আপনার সাধ্যের ভেতরে থেকেই। নয়তো একদিন দেখবেন সময়টা শেষ হয়ে গেল; কিন্তু আপনার খুব ছোটখাটো চাওয়াগুলি অপূর্ণ রয়ে গেল।

আপনি তো কেবল মা নন, একজন মানুষও।

শেয়ার করুন: