প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র-বিতর্ক এবং মূলধারার গণমাধ্যমের ‘স্পিকটি নট’ অবস্থান

কাবেরী গায়েন:
গত রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত ইফতার পার্টি ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি এই ইফতার পার্টিতে যে আলোচনা করেন, তা জাগোনিউজ২৪ নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ছাপা হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছাপা হবার পরে তাঁর বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। মূলত সামাজিক মাধ্যমে। তাঁর কিছু কিছু বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক মনে হয়েছে অনেকের কাছেই।
এই বক্তব্য নিয়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তখন কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, তিনি যদি এমন কথা বলেই থাকেন, তবে কেনো শুধু জাগোনিউজে ছাপা হলো? কেনো অন্য পত্রিকায় এলো না? এই সংবাদের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। এই প্রশ্নের সংগত দিক আছে।
প্রথমত মূল ধারার পত্রিকায় আসেনি। এলো কেবল কিছু নিউজপোর্টালে। একে একে শীর্ষ নিউজ, পূর্ব-পশ্চিমবিডিডটকম এবং আমাদেরসময়ডটবিজ, সময়ের কন্ঠস্বর-এ এই খবরটি ছাপা হয়। এই সবক’টি পোর্টালেই জাগোনিউজের খবরটি মূলত কপি-পেস্ট করা হয়। ডেইলি স্টার বাংলা ভার্সনেও এই খবরের একাংশ নিয়ে একটি খবর ছাপা হয়। এরই মধ্যে অনেকেই দেখলাম লাইন ধরে তুলে তুলে মন্তব্য করছেন যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এমন বক্তব্য দেয়া আসলে সম্ভব না। তিনি এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিণত। তাঁদের এই বক্তব্যে যদিও যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসজনিত আবেগের উপাদানই বেশি, কিন্তু অনেকেই এই যুক্তি গ্রহণ করলেন এবং মনে করলেন জাগোনিউজের খবরটি ভিত্তিহীন। কেউ বা আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এসেও এই খবরের সূত্র জানতে চাইলেন। সত্যি যে, জাগোনিউজ ছাড়া অন্য যেসব পোর্টালে খবরটি ছাপা হয়েছে, সবক্ষেত্রেই যেহেতু জাগোনিউজকেই মূলত কপি করা হয়েছে, দুই-একজন বন্ধু সাংবাদিকের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সূত্রে এই খবরের সত্যতা জানা গেলেও সেটা তথ্য হিসেবে প্রকাশ করা গেলো না।
জাগোনিউজ২৪ লিঙ্ক: https://www.jagonews24.com/…/%E0%…
পূর্বপশ্চিমবিডি লিঙ্ক: http://purboposhchimbd.news/…/%e0…
আমাদের সময় লিঙ্ক: http://www.amadershomoy.biz/unicode…
সময়ের কন্ঠস্বর লিঙ্ক: http://www.somoyerkonthosor.com/201…
ডেইলি স্টার লিঙ্ক: http://www.thedailystar.net/…/%E0…
অবশেষে ডয়েসেভেলে-র একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানটির প্রতিবেদন করার জন্য উপস্থিত ছিলেন এমন একজন সাংবাদিক (দৈনিক সমকাল) এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির সাথে কথা বলে এবং তাঁদের সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে এই প্রতিবেদনটি করেছে ডয়েসেভেলে। কাজেই আস্থা রাখা যায় এই প্রতিবেদনে। জাগোনিউজে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, তার সবক’টিই এই প্রতিবেদনে জানার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখা গেছে, জাগোনিউজের সাথে এই প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য এক। তবে উদ্ধৃতি হুবহু কপি-পেস্ট নয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বক্তব্য এক।
ডয়েসেভেলের লিঙ্ক: http://www.dw.com/…/%E0%A6%AA%E0%…
যেসব কারণে জাগোনিউজের রিপোর্ট অবিশ্বাস্য মনে হয়নি শুরু থেকেই
১। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের এক-আধটি শব্দ বা ধারণা অন্যভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। খুবই সম্ভব। কিন্তু জাগোনিউজের রিপোর্ট ছিলো খুবই গুছানো, পুংখানুপুংখ বিবরণ দেয়া। একজন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোটা মনগড়া বক্তব্য দিয়ে তুলে ধরা অসম্ভব। বিশেষত আজকের দিনে। উপরন্তু এটা ছিলো সাংবাদিকদের ইফতার পার্টি। এতোটা মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপিয়ে কারোরই পার পাওয়া সম্ভব না।
২। যেখানে এমনকি মাঠের মিছিলে দেয়া কোন স্লোগানের জন্য মামলা দেয়া হচ্ছে, চায়না পাটোয়ারীকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করা হচ্চছে ফেসবুকে সমালোচনার দায়ে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নামে যা তিনি বলেননি সে’বিষয়ে এতো দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপার পরেও প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বা আওয়ামীলীগের উপর মহল থেকে কোন প্রতিবাদ আসেনি দু’দিন পার হয়ে যাবার পরেও, এটি অবিশ্বাস্য।
৩। অন্তত দু’জন সিনিয়র সাংবাদিকের ফেসবুকে, যাঁরা ওইদিন ছিলেন অনুষ্ঠানে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভিন্ন ভিন্ন অংশের উল্লেখ দেখেছি। যেগুলো জড়ো করলে জাগোনিউজের বক্তব্যের সেই দুই প্রসংঙ্গের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়।
৪। জাগোনিউজের পোর্টালে গিয়ে দেখলাম এই পোর্টালে সম্ভবত ৮০ শতাংশ খবর ছাপা হয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে, এবং সেখানে তাঁর প্রতি পক্ষপাতেরই ইঙ্গিত আছে, বিরাগের নয়। ফলে, যাঁরা নির্বাচনকে সামনে রেখে মিথ্যা প্রতিবেদন ছড়ানো শুরু হয়েছে দাবি করছিলেন, সেই বক্তব্যে ভরসা রাখা যাচ্ছিলো না।
এবং, হাতে রইলো দুই অস্বস্তি
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যা জাগোনিউজ ছেপেছে তার সত্যতা ডয়েসেভেলের করা রিপোর্টে প্রমাণিত হবার পরে আনন্দিত হতে পারলাম না, যদিও যারা এই খবরের সূত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তার একটা সুরাহা হলো। এটা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হতো, তবেই বরং স্বস্তি পাবার বিষয় ছিলো। এটা প্রথম অস্বস্তি।
পাশাপাশি, আরেকটি অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে। মূলধারার পত্রিকাগুলোতে এই সংবাদ কেনো এলো না? ডয়েসেভেলের প্রতিবেদনে দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার অমরেশ রায়ের উদ্ধৃতি আছে। তিনি ছিলেন সেদিন। আছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের উদ্ধৃতি। কিন্তু সমকালে কি এই বিষয়ে রিপোর্ট হয়েছে? না হলে কেনো না? কেনো মূলধারার সাংবাদপত্র চেপে গেলো এই খবর? বরং ‘গুরুত্বহীন’ অন-লাইন নিউজপোর্টালগুলো প্রতিবেদন ছাপিয়েছে বলেই সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে ডয়েসেভেলে এই প্রতিবেদনটি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া না হলে হয়তো এই প্রতিবেদনটিও আমরা পেতাম না।
সংবাদমাধ্যম যদি নিজে থেকেই সেন্সরশিপে চলে যায় তো বিপদ। সব সংবাদপত্র বাতিল করে কেবল চারটি সরকারী সংবাদমাধ্যম চালু রেখে কিন্তু ১৫ আগস্টের ট্রাজেডি এড়ানো যায়নি। আজ যদি সাংবাদমাধ্যমগুলো নিজেরাই সেন্সরে চলে যায় নানা সুযোগ-সুবিধা-বিপদ-আপদের কথা ভেবে, তবে সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা দেশবাসী জানতেও পারবেন না। কাম্য তো বরং বিরোধেীদলের অনুপস্থিতিতে গণমাধ্যমের শক্তিশালী অবস্থান। শুধু দেশবাসীর জন্যই নয়, সরকারের জন্যও শক্তিশালী গণমাধ্যম শেষ বিচারে আশীর্বাদ। জনপরিসরের বিতর্কে সরকার না এলে কীভাবে জানবেন তার সিদ্ধান্তে মানুষের আস্থা আছে কি না? কিংবা ভোটের বৈতরণী পার হবার জন্য হেফাজতই একমাত্র ভরসাস্থল নয়?
শেয়ার করুন: