পুরুষ, আপনারা আমাদের চলার পথের সাথী

ফারজানা আক্তার:

আমাদের দেশের হাজারটা সমস্যার মধ্যে ধর্ষণ এক নাম্বারে আছে! ধর্ষক আর ধর্ষিতা মধ্যে আমাদের প্রিয় আলোচনার বিষয় হচ্ছে ধর্ষিতা! তার কেনো ছেলেবন্ধু থাকবে! সে কেনো উল্টা পাল্টা পোশাক পরবে! সে কেনো বাহিরে যাবে! সে কেনো পার্টিতে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বনানীর ঘটনায় সব থেকে বেশি যে কমেন্টস দেখতে পাচ্ছি তা হলো – মেয়ে দুটো কেনো পার্টিতে গেলো। মেয়েদের কেনো ছেলে বন্ধু থাকবে। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস কেনো করতে গেলো!

ছোট্ট মেয়ে পূজা তার কথা মনে আছে নিশ্চয়? তাকে কি তার বন্ধু ধর্ষণ করেছিলো? সে কি পার্টিতে গিয়েছিলো? যে বাবা তার মেয়েটাকে নিয়ে আত্মহত্যা করলো সেই মেয়েটি আপনাদের কোন পার্টিতে গিয়েছিলো? ধর্ষক কি এই মেয়েটার বন্ধু ছিলো? ৮০বছরের বৃদ্ধা যে মহিলাকে ধর্ষণ করেছিলো সে কোন পার্টিতে গিয়েছিলো ভাইয়েরা আমার? গারো যে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করলো, সেও কি পার্টিতে ছিলো ভাইয়ারা?

এখন একটু কথা বলি “পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস কেনো করতে গেলো !” এই বিষয়টা নিয়ে। পুরুষরা হলো আমাদের চলার পথের সাথী। কেন আমরা তাদেরকে বিশ্বাস করবো না? চলার পথের সাথীদের বিশ্বাস না করলে সামনে আগাতে পারবে কোনো জাতি, দেশ, সমাজ? চলার পথের সাথী বলতে শুধু প্রেমিক বা স্বামীকে বুঝাচ্ছি না। আপনি চাকরি করেন সেই অফিসের মানুষগুলো কিন্তু আপনার ক্যারিয়ারের চলার পথের সাথী। আপনি পড়াশোনা করছেন সেই ক্লাসের বন্ধুগুলো আপনার শিক্ষা জীবনের চলার পথের সাথী। চলার পথের সাথীরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হয়, তবে তাদের পরিচয় এক তারা চলার পথের সাথী।

আমি প্রথম যে চাকরিটা পাই সেখানে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম। প্রথম প্রথম মানুষিকভাবে খুব বিব্রত ছিলাম।  ভাবছিলাম হয়তো বেশিদিন কন্টিনিউ করতে পারবো না। কিন্ত আমার সব ভয়, আশংখা দূর করে দিলো আমার অফিসার বস আর কলিগরা। বস আর কলিগ বললে ভুল হবে, এরা সবাই আমার বড় ভাই ছিলো।  একটা বড় ভাই ছিলো না বলে খুব আফসোস ছিলো আমার কিন্ত ওই অফিসে যেয়ে আমার সব আফসোস এক নিমিষেই দূর হয়ে গেলো! ঝড় – বৃষ্টির সময় বা যেদিন কাজের জন্য রাত হয়ে গেছে সেদিন আমার হোস্টেল পর্যন্ত ভাইয়ারা দিয়ে গেছে। এরা সবাই কিন্ত পুরুষ মানুষ, আর আমি  এদের বিশ্বাসও করেছি কই আমার তো কিছু হয় নাই। উল্টা তখন আমার হোস্টেল থেকে অফিসেই নিজেকে বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে। এরা ছিলো আসল পুরুষ মানুষ কোনো কা – পুরুষ বা অমানুষ ছিলো না।

এখন আমি যেখানে চাকরি করছি এখানেও কোনো মেয়ে নাই। এখানেও আমি সব পুরুষ মানুষদের সাথে কাজ করছি আর যখন কাজ করছি তখন আমার মনে হয় না আমি এতগুলা পুরুষ মানুষের সাথে কাজ করছি ! মনে হয় আমি পরিবারেই আছি আর পরিবারের সদস্যদের সাথে কাজ করছি। অনেকের মুখে শুনি অফিস কলিগ, বস খারাপ প্রস্তাব দিচ্ছে ! যে কা-পুরুষ নিজের সহকর্মীকে সহকর্মী না ভেবে তার শরীর নিয়ে ভাবে, সেই কা-পুরুষ তার  নিজের কন্যাকে  কন্যা ভাবতে পারে তো? নাকি তারও শরীর নিয়ে ভাবে! করুণা হয় এমন কা-পুরুষদের জন্য, আর লজ্জা লাগে আসল পুরুষদের জন্য যাদেরকে আমরা কা-পুরুষদের সাথে মিলিয়ে ফেলি।

একদল কা-পুরুষ ধর্ষণ করে, অন্য কা-পুরুষরা মেয়েদের পোশাক আর বাইরে যাওয়া নিয়ে নেচে নেচে গল্প বলে বেড়ায়।  এরা নিজেরাই বুঝতে পারে না নিজেরা নিজেদের কতটা ছোট করছে। এক মেয়ে বাইরে যাবে, ছোট পোশাক পরবে আর তুমি তাকে দেখে দেখে মজা নিবা? কেনো তোমার ব্যক্তিত্ববোধ নাই? তুমি সবার সামনে কী প্রমাণ করছো? তোমার কন্ট্রোলিং পাওয়ার নাই, নাই তোমার ব্যক্তিত্ববোধ, না আছে চক্ষুলজ্জা ! আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো, আপনারা যারা মেয়েদের ছোট পোশাক দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যান,  তারা কি আপনার মা বা বোনের একটু অসতর্কে কাপড় সরে গেলেও উত্তেজিত হয়ে যান ?

আপনারা আমাদের চলার পথের সাথী।  নিজেরা নিজেদের এত নিচে নামাবেন না। মনে কোনো ভয়, দ্বিধা না রেখে আমরা আপনাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চাই। আপনারা আপনাদের মনের কালি দূর করে আলোর পথে আসুন।  দেখুন সৎ মন নিয়ে চললে জীবন কতো সুন্দর হয়ে যায়। সুন্দর জীবনে আপনাদের জন্য রইলো শুভ কামনা।  

শেয়ার করুন: