পাহাড়ের কান্না কি শুনতে পাও?

শান্তা মারিয়া:

আমরা হচ্ছি গোল্ডফিশের মেমোরি নিয়ে জন্ম নেওয়া উটপাখির জাত। আমরা ফেসবুকজীবী বললেও অত্যূক্তি হয় না। যে কোনো নির্মম নৃশংস ঘটনা আমরা অতি দ্রুত ভুলে যেতে পারি। আবার একই সঙ্গে বালিতে মুখ গুঁজে আমরা ভাবি, কই কিছুই হয়নি তো!

পাহাড়ের ভয়ংকর অপরাধগুলোর প্রতি আমরা আর কতদিন চোখ বন্ধ করে থাকবো বলুন তো? আমরা বলতে এখানে আমি ঢাকাশহর ও দেশের অন্য বড় শহরনিবাসীদের কথা বলছি। এর ভিতরে আমিও আছি। আমি নিজেকে বাদ দিয়ে সমালোচনা করছি না।

তিনদিন আগে পাহাড়ে রমেল চাকমা নামে এক তরুণকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এ খবরটি ফেসবুকের কল্যাণে আমরা অনেকেই জেনেছি। কিন্তু তারপরও দিব্যি চুপ করে আছি অধিকাংশ মানুষই। একমাত্র ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। আর কোথাও কিছু নেই। আমরা কী ভাবছি? ভাবছি যে একটি পাহাড়ি ছেলেকে মেরেছে তাতে কি এসে গেল? নাকি ভাবছি, এর বিরুদ্ধে বললে আমরাও বিপদে পড়বো? কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না বলেই কি কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না? মনে রাখবেন, এভাবে চলতে থাকলে যেদিন আমি বা আপনি মারা যাবো সেদিনও কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না।  

যারা এখনও খবরটি জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে ঘটনার বিবরণ জানাচ্ছি সংক্ষেপে।

ফেসবুকের কল্যাণে আদিবাসী অনেক বন্ধু রয়েছে আমার। তাদের পোস্টে পেলাম রমেল চাকমাকে হত্যার খবর। এমনিতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে খবরটি আসেনি। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে কেন খবরটি আসেনি বা কেন খবরগুলো আসে না সেটাও আমরা বেশিরভাগই হাড়ে হাড়ে জানি।

রমেল চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তার লাশ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও আমার আদিবাসী বন্ধুরা অভিযোগ করেছেন। রমেল চাকমাকে হত্যার পুরো বিবরণ পেলাম আরেকজনের পোস্টে। গা শিউরে ওঠা সেই বিবরণ। রমেল চাকমা কৈশোর পেরিয়ে সদ্য তারুণ্যে পা রাখা একটি নিরীহ গোছের ছেলে। সে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছিল নানিয়াচঙে। এদিকে এক সেটেলার মারা গেছে বলে সেনাবাহিনী আসে সেখানে। রাস্তা থেকে ধরপাকড় শুরু করে এবং অযথাই ধরে নিয়ে যায় ছেলেটিকে। শুরু করে মারধোর নির্যাতন। ছেলেটি যতই বলে আমি কিছু করিনি তাতে কেউ কর্ণপাত করে না। তারপর নির্যাতন করতে করতে সেই ছোটখাটো নিরীহ ছেলেটিকে তারা মেরেই মেলে। তারপর তার মৃতদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দূর পাহাড়ে বসবাসরত তার দরিদ্র বাবা মা প্রিয় সন্তানকে এক নজর শেষ দেখাও দেখতে পায়নি।

ঘটনাটি যতই শুনছি আমি ঘুমাতে পারছি না। ওর মায়ের কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে তার বুকের ভিতরে কি হাহাকারই না গুমরে মরছে। কেন রমেল চাকমাকে মেরে ফেলা হলো? এই হত্যার কি কোনো বিচার নেই? প্রতিকার নেই?

রমেল চাকমাই অবশ্য প্রথম নয়। এর আগে আরও অনেক আদিবাসী পাহাড়ে খুন, ধর্ষণ, গুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পাহাড়ের প্রতিবাদী নারী কল্পনা চাকমাকেও আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি মধুপুরের অনেক প্রতিবাদী সাঁওতাল নারী-পুরুষকে। পাহাড়ে আজও কেঁদে বেড়াচ্ছে গুম খুনের শিকার অনেক প্রতিবাদী আদিবাসী আত্মা। শুধু পাহাড়ের আদিবাসী নয়, এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সমতলের আদিবাসীরাও। সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, ওঁরাও, মান্দি এবং পাহাড়ের চাকমা, মারমা, তঞ্চংগ্যা থেকে শুরু করে প্রায় সব আদিবাসী গোষ্ঠিই ভূমি দখল, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও গুম-খুনের শিকার।

কেন তারা এ ধরনের নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন? কারণ তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে বা মা-নানীর (মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) আমল কিংবা তারও অনেক অনেক যুগ যুগান্তর আগে থেকে বংশানুক্রমে ব্যবহার করা, অধিকার করা জমির উপর চোখ পড়েছে বাঙালি সেটেলারদের। তার সেই জমি থেকে বিতাড়িত করছে আদিবাসীদের। একই কায়দায় মধুপুর উত্তরবঙ্গের সমতলের আদিবাসীদেরও বিতাড়ন করা হচ্ছে। নিজভূমে তাদের পরবাসী করে দেওয়া হচ্ছে।

পাহাড়ের ভূমির প্রকৃত অধিকারী তো সেখানকার আদিবাসীরাই। একথা তো স্বাভাবিক বুদ্ধিবলেই বোঝা যায়। এজন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধিবলে বুঝলেও সেটা দিয়ে তো ধান্দাবাজি করা যায় না। তাই আদিবাসীদের ভূমি দখল করার জন্য ভাসুরসম একটি বাহিনীর (কারণ তার নাম মুখে আনতে মানা) সাহায্যে চলছে নির্যাতন নিপীড়ন।

আমেরিকা মহাদেশে যেভাবে রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভূমিতে তাদেরই পরবাসী করে দেওয়া হয়েছিল নির্মম নির্যাতন চালিয়ে, যেভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ও নিউজিল্যান্ডে আদিবাসী অ্যাবরোজিনি ও মাওরিদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে আমাদের পাহাড়েও চলছে নির্যাতন। সেখানে নির্যাতন চালিয়েছিল সুসভ্য বলে দাবিদার ‘সভ্যতার বোঝা বহনে নিবেদিত’ (হোয়াইট ম্যান’স বারডেন) শ্বেতাঙ্গরা।

আর এখানে নির্যাতন চালাচ্ছে সংস্কৃতিবান বাঙালি ও জাতিসংঘের প্রশংসাধন্য বাহিনী। রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে এই কুচক্রের মধ্যে।

আদিবাসীদের উপর এই নির্যাতন চলছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই। কাপ্তাই বাঁধের মাধ্যমে ঢাকাকে আলোকিত করতে গিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হয় আদিবাসীদের ভূমি ও রাজপ্রাসাদ। অথচ এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা যেত অন্য জায়গাতেও। আদিবাসীদের পাহাড় বিক্রি করা হয়েছে বাঙালি সেটেলারদের কাছে জলের দামে। বংশানুক্রমিক ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে আদিবাসীদের।

আদিবাসীরা দরিদ্র। তারা অনেকেই মৌজা, দাগ নম্বর ইত্যাদি ভক্কর-চক্কর বোঝে না। সেই সুযোগে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তারা সরল ও দরিদ্র। তাই তাদের উপর চলেছে নিপীড়ন।

একসময় ‘ধর্ষণ’ বিষয়টিই অজানা ছিল আদিবাসীদের কাছে। অথচ বাঙালিরা পাহাড়িদের নারীকে করেছে যেন নিছক ‘ধর্ষণের সামগ্রী’।

তাদের শিশুদের করা হয়েছে গৃহহারা। আমার এক আদিবাসী বন্ধু তার ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি আতংক ছাড়া আর কোনো শৈশব স্মৃতিই মনে করতে পারেন না।

কিন্তু কেন এই অবিচার? আদিবাসীরা কি এদেশের নাগরিক নন? সংবিধানে ঘোষিত নাগরিক অধিকারগুলো কি তাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়?

এক্ষেত্রে আমাদের সুশীল সমাজেরসহ সকল বেসামরিক ও সেটেলার নন এমন বাঙালিরও কিন্তু দায় রয়েছে। আমরা বিশ্বজুড়ে অমুক তমুকের সঙ্গে ব্রাদারহুড ফলাতে ব্যগ্র। কিন্তু এদেশেরই আদিবাসী সমাজের সুখ-দুঃখ, নিপীড়ন, নির্যাতন নিয়ে আমরা চোখ বন্ধ করে রাখি।

কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। নগর পুড়লে দেবালয়ও বাদ থাকে না। পাহাড়ে জমা হচ্ছে ক্ষোভের বারুদ। সেই বারুদে যেদিন বিস্ফোরণ ঘটবে সেদিন কিন্তু সুশীল বাঙালির দেহও ঝলসাবে। সেদিন ‘আমি তো কিছু করি নাই ভাই’ বলে পার পাওয়া যাবে না। তখন বলা হবে, ‘কেন কিছু করো নাই?’

প্রতিবাদ করা তো অন্ততঃ কর্তব্য ছিল একজন মানুষ হিসেবে, একজন একদেশবাসী হিসেবে। পাহাড়ে সকল প্রকার দখলদারি, নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধে আওয়াজ তোলা, তীব্র প্রতিবাদ জানানো এখন সময়ের দাবী। আসুন, যাদের মধ্যে কিছুটা মানবিকতা এখনও বেঁচে আছে তারা প্রতিবাদ জানাই। সব জায়গায় লাভ-লোকসানের হিসাব কষলে চলে না। সব জায়গায় ভয় পেলেও চলে না। আসুন আদিবাসী ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াই।  নিজেদের পাপ কিছুটা হলেও স্খলন করি।

পাহাড় কাঁদছে। কাঁদছে এদেশের আদিবাসী প্রাণ। আপনারা কি সেই কান্না শুনতে পাচ্ছেন না?

শেয়ার করুন: