পোশাকধারী মোল্লারাও দেখি ‘সেই পুরুষ’

সেবিকা দেবনাথ:

ঘটনাটা আজ ২১ এপ্রিল, দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে। মোল্লাদের সমাবেশ চলছে। পুরো মতিঝিল তাদের দখলে। মতিঝিল থেকে সব গাড়ি জনতা ব্যাংকের মোড় হয়ে গুলিস্তান, জিরো পয়েন্ট হয়ে সচিবালয়ের সামনে দিয়ে বের হচ্ছে। আমাকে নামিয়ে দিলো জিরো পয়েন্টে।

আমি নিজস্ব গতিতেই হেঁটে পল্টনের অফিসে আসছি। আমার সামনে আরও চার-পাঁচজন মেয়ে বেশ সাজুগুজু করা। তারা হয়তো বেড়াতে বেরিয়েছিলো। মোল্লাদের সামনে দিয়ে যেতে হবে তাই তারা জর্জেটের ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলো। আমি জিরো পয়েন্ট থেকে রাস্তা পার হয়ে সচিবালয়ের মোড়ের ফুটপাতে উঠেছি।

বয়স্ক এক মোল্লা বসে আছেন রাস্তায়। আমার দিকে চোখ বড় বড় করে ধমকের সুরে তিনি আমাকে বললেন, ‘এই মাইয়া মাথায় কাপড় নাই কেন?’ অস্বীকার করবো না, কিছুটা ভয়ও পেয়েছি। লোকটাকে দেখতে অস্বাভাবিক লাগছিলো। টুপি পরা এতো মোল্লা দেখে আমার হেফাজতের সমাবেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো।

সেদিন বঙ্গভবন পার্কের রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। জলের বোতল ও প্লাস্টিকের হাত পাখা উঁচিয়ে সেদিন মোল্লারা আমাকে মারার জন্য তেড়ে এসেছিলো। একজন তো জলের বোতল ছুঁড়েও মেরেছিলো। কিন্তু অল্পের জন্য গায়ে লাগেনি। আমার অপরাধ ছিলো, মাথায় কাপড় না দিয়ে কেন রাস্তায় বের হয়েছি। তেড়ে আসতে আসতে তারা সেদিন বলেছিলো, ‘এদেশে থাকতে হইলে মাথায় কাপড় দিয়া চলতে হইবো।’

সেদিন ওই মোল্লাদের হাত থেকে আমি বেঁচে ছিলাম পুলিশের জন্য। রাস্তার মোড়ে পুলিশদের দেখে মোল্লারা হয়তো সেদিন আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। ওইদিনও সারা রাস্তা ওই এক কথা শুনতে শুনতে আসতে হয়েছে আমাকে। আজও আমি একই দোষে দোষী। আর তাই মোল্লারা ওই একই কথা বললো। মাথায় কেন কাপড় নাই! জিরো পয়েন্ট থেকে পল্টন অফিসে আসতে কম করে হলেও দশ বার শুনতে হয়েছে এই কথা। এদের মধ্যে একবার এক মোল্লা বললো, ‘এত বড় দেহটা, ঢাইকা রাখা যায় না?’ এর মানেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। যখন বুঝলাম তখন রাগে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো।

শুনতে সাধারণ মনে হলেও কথাটা তো অশ্লীল। এতো বড় দেহ মানে কী? ঢাইকা রাখা যায় না মানে? আমি তো কাপড় ছাড়া বাইরে বের হইনি? বড় একটা ওড়নাও পরেছি। দাঁতে দাঁত চেপে রাস্তা চলছি। এর মধ্যে আরেক মোল্লা বললো, ‘সাইজ তো মাশআল্লাহ। বোরকা পরা যায় না?’ ঘুরে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মোল্লা অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। আমি জানি সব মোল্লা এক নয়। আমি ওই কথার প্রতিবাদ করলে হয়তো কেউ সুরাহা করার চেষ্টা করতেন। উল্টোটাও হতে পারতো। যুথবদ্ধ হয়ে আমার উপর চড়াও হতে পারতো।

কেন যেন তখন কথা বাড়ানোর চেয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো বেশি। টের পাচ্ছিলাম পুরো শরীর কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলো। দেহ আমার দেহ বয়ে নিয়ে বেড়াই আমি, আর অস্বস্তি হয় ওদের! মনে ইসলাম, মাথায় টুপি, পরনে আলখাল্লা আর গালভর্তি দাঁড়ি নিয়ে এসব অশ্লীল কথা ওরা কীভাবে বলে? নিজের মুখ আর চোখকে সংযত করার কথা কি ইসলামে বলে নাই? খালি মেয়েদেরই পর্দা করতে বলেছে? আর একটা কথা, এই দেশে মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মের লোকজন বসবাস করে। তাদের জন্য মাথায় কাপড় দিয়ে চলা কিংবা বোরকা পরার কোন বিশেষ বিধান নাই। এই কথাটা কেন তারা ভুলে যায়? নাকি অন্য ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্বকে তারা অস্বীকার করতে চায়? এতে কি বেশি সওয়াব মিলে?

নিজের কিংবা অন্য ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি নিতান্তই তলানিতে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ধর্মের দোহই দিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলার কথা কোন ধর্মের কোথাও বলা নাই। তথাকথিত নাস্তিকদের চেয়ে ওই সব পোশাকধারী মোল্লারা ইসলামের জন্য কয়েক হাজার গুণ বেশি বিপদজ্জনক। ইসলামের মূল বার্তা (১৬ আনা ঈমান) তারা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.