ফওজিয়া খোন্দকার ইভা:
২৪শে এপ্রিল, কমলার, মানে আমাদের প্রিয় কমলা ভাসিনের ৭১ তম জন্মদিন। আমার আজকের সবটুকু ভালোবাসা তাঁর জন্য।
কমলা ভাসিন দক্ষিণ এশিয়ায় এক অতি পরিচিত নাম। এই উপ-মহাদেশের একজন প্রখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও জেন্ডার প্রশিক্ষক। নারী -পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এমনই মানুষ তিনি, যে কিনা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে বেড়ায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ছুটে বেড়ায় নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য। এক অসীম সাহসী, ত্যাগী আর নিবেদিত প্রাণ কর্মী।
কমলা কেন এতো জনপ্রিয়? দক্ষিণ এশিয়ায় তো আরও অনেক নারীবাদী, নিবেদিত প্রাণ কর্মী রয়েছেন, কিন্তু আমাদের কাছে কেন সে এতো প্রিয়? তার একটি প্রধান কারণ, তাঁর ভালোবাসতে জানা। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ভালোবাসার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। তিনি মনে করেন, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভালোবাসা। তাই কমলা বলেন, ” ক্ষমতার প্রতি ভালোবাসা নয়, ভালোবাসার ক্ষমতা” (Not Love of Power, power of love)। তার ভালোবাসার মানুষ সকলেই। সে যে ধর্মের, যে বর্ণের, যে শ্রেণীরই হোক না কেন।
একজন অত্যন্ত সফল ও দক্ষ প্রশিক্ষক কমলা । সারা দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতেই তার মতো একজন জেন্ডার প্রশিক্ষক পাওয়া কষ্টসাধ্য। তার চাইতে জ্ঞানী হয়তো আরো অনেকেই রয়েছেন, কিন্তু তার দেবার যে কৌশল, তা অনেকেরই নেই। জীবনের সাথে সঙ্গতি রেখে, জীবন থেকে নেয়া অভিজ্ঞতাগুলো তিনি উদাহরণ হিসেবে দিয়ে যান। প্রয়োজনে আপনজনকেও উদহারণ হিসেবে নিয়ে আসেন। আপনজনকেও প্রশ্ন করতে দ্বিধা করেন না।
পিতৃতন্ত্রের স্বরূপ এবং পিতৃতন্ত্রকে নিয়ে এতো বলিষ্ঠ ভাষায় কথা বলা তার পক্ষেই কেবল সম্ভব। পিতৃতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ” পিতৃতন্ত্র কোনো একমাত্রিক, সরল তত্ত্ব নয়; বিভিন্ন জনের বিশ্লেষণে এর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে”। কামলা ভাসিন দারুণ দক্ষতার সাথে এই জটিল বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করেন। শুধু পিতৃতন্ত্রই নয়, নারীবাদ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, পুরুষসুলভতা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নিয়েও তার লড়াই চলছে। এ লড়াই কখনো শ্লোগানের ভাষায়, কখনো গানের ভাষায়, কখনো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, আর কখনো প্রতিবাদে ফেটে পড়ার মাধ্যমে।
কমলা প্রতি বছর এক মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ আয়োজন করেন যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণ একজন নারীর ভেতর রূপান্তর ঘটায়। তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। নারী তার পারিপার্শ্বিকতাকেই শুধু নয়, নিজেকেও প্রশ্ন করে, প্রশ্ন করে তার প্রতিদিনের কাজকে, তার অবদমিত ভালো লাগা বা আকাংখাকেও জাগিয়ে তোলে। নারী নিজেকে ভালোবাসতে শেখে। নিজের দিকে তাকাতে শেখে, নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। নারী প্রতিবাদী হতেও শেখে। শুধু হা-হুতাশ নয়, নারীর লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন তিনি।
প্রখ্যাত এই নারী আন্দোলন ও অধিকার কর্মী নানা বিষয়ের উপর বহু বই লিখেছেন। যার মূল বিষয়বস্তু হলো উন্নয়ন, জেন্ডার সমতা, পিতৃতন্ত্র, নারীবাদ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ইত্যাদি। অনেক বই-ই তিনি লিখেছেন, বিশেষ করে উন্নয়ন কর্মীদের জন্য। কঠিন বিষয়কে তিনি সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন। শুধু লিখেই শেষ করেননি, দায়িত্ব নিয়ে তা বিতরণও করেছেন বিভিন্ন জায়গায়।
পরম মমতায় গড়ে তুলেছেন সাঙ্গাত (SANGAT) নামে দক্ষিণ এশিয়া নারী নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নিজের উপার্জন থেকে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করে যান নারী সংগঠনগুলোকে। নারী পুরুষের সমতার লড়াইয়ে অনমনীয় একজন যোদ্ধা আমাদের কমলা, যাকে ভালোবেসে আমরা বলি, ‘কমলাজী’।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতিবাদে সোচ্চার এই মানুষটি নিজের জীবনের অনেক কষ্টকে সামনে না এনে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাঁকে বলতে চাই,
“তোমার রঙিন পাতায় লিখবো প্রাণের কোন বারতা?
রঙের তুলি পাবো কোথা।
সে রঙ তো নেই চোখের জলে,
আছে কেবল হৃদয় তলে।
প্রকাশ করি কিসের ছলে মনের কথা “