একজন মা ও তার সন্তান পালনে মানসিক দ্বন্দ্বের ব্যবচ্ছেদ

জিন্নাতুন নেছা:

একটা কথার প্রচলন আছে মাতৃত্ব একজন নারীর জন্য পরিপূর্ণতা। সবার মুখেই বলতে শুনি সংসার জীবনেরও নাকি পূর্ণতা আসে সন্তান হলে। এমন ঘটনারও অভাব নাই যেসন্তানএর উপর ভিত্তি করে সংসার টিকে আছে। সন্তান আছে, কিন্তু কোন দম্পতি যদি তাদের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি চান বা ডিভোর্স চান, তাহলে তার পরিবার, সমাজ কিংবা সালিশের লোকজনো বুঝায় এভাবে যে,  মা, “একটা বাচ্চা আছে তার দিকে তাকিয়ে অন্তত সংসার করো।

আমি বুঝতে পারি না সংসার আগে তৈরি হয়, নাকি সন্তান আগে আসে সংসারে। আমার মনে হয় একটি সংসারের ভালোবাসার পরিণতি হলো তারসন্তান। তাহলে কী করে একজন সন্তান সংসারের ভিত্তি হতে পারে?

আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো সন্তান একজন নারীর জন্য বহুগুণ পিছিয়ে যাওয়ার কারণ। একটা ঘটনা খুব বেশি মনে পড়ছে। ঘটনাটি মনে হলেই আমার চোখ দিয়ে কখন যে জল গড়িয়ে পড়ে আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। আমার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের প্রায় এক বছর পরের ঘটনা।

আমি কোনদিন চাইনি আমার ছেলেকে আমার মায়ের কাছে রাখবো। গর্ভাবস্থায় সন্তানকে (তখনো জানার চেষ্টা করিনি ছেলে না মেয়ে) পেটে নিয়ে বাড়িতে যাই এবং এর সাতদিন পর আমার সিজার হয়। জন্ম নেয় ফুটফুটে ছেলে সন্তান। আমার স্বামী কিন্তু এক মাস পরে আমায় দেখতে গিয়েছিলো। কারণ ছিল, তার পরিবারে (শ্বশুর) মেয়ে নাই, তাই তার মেয়ে চাই। যাই হোক সন্তান প্রসবের ৪০ দিনের মাথায় ঢাকা আসি, যথারীতি ক্লাস, পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট, অবশেষে ফাইনাল পরীক্ষা। ছেলে কিন্তু সবসময় আমার সাথে থাকতো। ওকে নিয়ে ক্লাস করেছি, টিউশনি করেছি……

কিন্তু ছেলের বয়স যখন চার বছর সংসার ভেংগে গেল, ছেলেও বড় হতে শুরু করলো, দুরন্তপনা সব মিলিয়ে আমি ওকে কোথাও নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখে কাজ করতে পারতাম না। একসময় সবাই বিরক্ত হতে শুরু করলো। টিউশনির বাসা থেকে শুরু করে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম পার্ট টাইম, সেখানেও। এমনকি বাড়িওয়ালা সাবলেট দিতে চাইতো না আমার ছেলে আছে বলে। তাদের বিরক্ত করবে এই ভেবে।

তখন বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে রেখে আসলাম বাড়িতে (বগুড়া)। খুব কষ্ট হতো, বহুদিনের অভ্যাস ছেলেকে নিয়ে ঘুমাই, কিন্তু এখন কাছে পাচ্ছি না। কতদিন যে রাতে ঘুমের ঘোরে ছেলেকে খুঁজেছি, তার ইয়ত্তা নাই। আবার আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের (ফাতেমা বাশার) বলা একটি কথা মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম ছেলের প্রতি এতো আবেগ থাকলে ক্যারিয়ার গড়তে পারবা না!”

আমি ম্যামের সাথে এক একাডেমিক গবেষণা কাজে ফিল্ডে গিয়ে বার বার বাড়িতে ফোন করে ছেলের খবর নিচ্ছিলাম। তখন ম্যাম এই কথাটি বলেছিলো। আমি এখনো এই কথার দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। আমি ভাবি, সত্যিই তো সন্তানকে মা ভালোবাসে, কিন্তু তার অর্থ কি আমার একান্ত নিজের বলতে কিছু নাই? আমি প্রচণ্ড রেগে যাই আমায় কেউ অরিনের মা বলে ডাকলে, কারণ আমি বিশ্বাস করি আমি নারী, (আমার একটা নাম আছে) তারপর আমি কারো বউ (ছিলাম), তারপর আমি মা।

ঘটনাটি এখনো বলা হয়ে ওঠেনি, আমি এখন যেমন সিংগেল মাদার হিসেবে একধরনের বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাই, তেমনি আমি যখন ছাত্র মা ছিলাম, তখনও এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি আমার ছেলেকে কোথায় রেখে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিবো তা ঠিক করতে না পেরে অবশেষে অনেক অনুরোধ করে এক বান্ধবীর কাছে রেখে ৩০ মিনিট পর হলে ঢুকি, এটাও এক বাস্তবতা।

আমার স্বামী কিন্তু ঠিকই অফিসে চলে গিয়েছিলো। এমনকি ছেলেকে মার বাড়িতে রাখার পর ঈদে বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু ছেলের জিদের কাছে হার মেনে ঢাকায় নিয়ে আসি, কিছুদিন ঘুরিয়ে আমার ছোট ভাই নিয়ে যাবে এই সিদ্ধান্তে। আমার পরীক্ষার একদিন আগে ছেলেকে পাঠিয়ে দিবো, কিন্তু কোনভাবেই সে যাবে না তার মামার সাথে। সেদিন ছেলের সেই কাকুতি-মিনতি, কান্নাকাটি আর আর্তনাদ আমার কানে ভাসে, আমার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে।

আমার মনে হচ্ছিলো, আমি মা হিসেবে ব্যর্থ, আমি পাপী। কেঁদেছিলাম, সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। সান্ত্বনা দিয়েছিলাম,আমি আগে নারী, তারপর মা

আমার মনে হয় কর্মজীবী মা, ঘরোয়া মা (যারা কেবল ঘরে সংসার সন্তান মানুষ করে), ছাত্র মা, কিংবা পড়ালেখা করা শিক্ষিত মা যারা হতে পারে নিজের ইচ্ছায় (এই কথা বললাম, কারণ এমন অনেক উদাহরণ আছে, যাদের স্বপ্ন পড়ালেখা করেছি ঠিকই আছে, কিন্তু সংসার আর সন্তান মানুষ করবো), স্বামীর অনিচ্ছা, পরিবারের অনিচ্ছা ইত্যাদি কারণে চাকরি করতে পারছেন না, তাদের মাঝেও এধরনেরমানসিক দ্বন্দ্বকাজ করে।

যারা পারেন না নিজের ক্যারিয়ার গড়তে, আবার পারেন না সন্তানের দিকেও মনোনিবেশ করতে। কর্মজীবী নারীদের নিয়ে যখন কাজ করেছিলাম তখন সব উত্তরদাতা আক্ষেপ করে বলতো, “আপা চাকরি করি, সংসার করি, ছেলেমেয়েকে দেখাশোনা করি, আবার শ্বশুর বাড়ির মনও রক্ষা করে চলতে হয়।নারী সবদিক সামাল দিয়ে চলে, কিন্তু নারীর মাঝে যে মানসিকডিলেমাকাজ করে, তা নিয়ে কেউ কি ভাবে?

নারী চাকরি করতে চাইলে ইদানিং স্বামীরা নতুন নখড়া শুরু করেছে, বলছে, তোমাকে বিসিএস ক্যাডার বা সরকারি কোন ভালো চাকরি পেতে হবে না, হইলে চাকরি আমি করতে দেবো না!!” আসলে চাকরি করতে না দেয়ার নতুন পন্থা। তখন বলি, তুমি (স্বামী) একটা সরকারি চাকরি নিয়ে দেখাও তো…….!

নারীরা এভাবেই ভুলে যায় তার নারীত্বকে, তার বদলে সমাজ মাথায় ঢুকিয়ে দেয় তার মাতৃত্বকে। মা হলেই যেন নারীর পূর্ণতা। এমনকি কর্মজীবী নারী তার সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থায় সন্তান জন্মদানের পরও নানা মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যায়। কারণ সে তার জব প্লেস থেকে শুরু করে পরিবারে, সমাজে, সব জায়গায় কীভাবে মানিয়ে নেবে, কীভাবে চাকরি চালিয়ে যাবে, এমনকি তার মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যে একাকিত্ব থাকে, সেই মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়েও ভাবার লোক নাই।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সন্তান একজন নারীর জন্য ভালোবাসার, আবেগের জায়গা হলেও নারীকে বুঝতে হবেএকজন নারী আগে নারী তারপর মা। তাহলে মনে হয় মাতৃত্ব, সন্তান আর নারীত্ব নিয়ে নারীর যে মানসিক দ্বন্দ্ব কাজ করে, তা অনেকাংশে কমিয়ে যাবে বলে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলবো। আবারো বলবো, আমরা নারী, তারপর আমরা মা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.