চৈতী সাহা:
মানুষের যখন বিবেকের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখনই তার লিখিত আইনের প্রয়োজন হয়। সব মানুষের বিবেক থাকবে বা একইভাবে কাজ করবে, এটা আশা করা যায় না বলেই দেশ ও জাতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য লিখিত আইন লাগে। আবার যখন লিখিত আইন মেনে চলার জ্ঞানটুকুও লোপ পায়, তখন পশু-পাখির মত খাঁচায় পুরে রাখতে হয়।
একটা জাতির অবস্থা কতটা করুণ হলে তাকে তার শেকড়ের কথা আইন করে মনে করিয়ে দিতে হয়! বাঙালী বাংলা নববর্ষ পালন করতে চায় না। তাকে বাধ্য করতে হয় তার সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সম্মান করতে। ছোটবেলাতে দেখেছি আমরা যখন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে কেনাকাটা করতাম তখন কিছু কিছু বন্ধুকে মন খারাপ করতে। কারণ তাদের বাড়িতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হতো না, এমনকি ঐদিনে ওদেরকে বাড়ি থেকেও বের হতে দেয়া হতো না।
আজ একটা রাজনৈতিক নাম নিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ে যারা সংঘবদ্ধভাবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমেছে, তারা এই সাহস হাওয়া থেকে পায়নি। তারা জানে, তাদের পাল্লায় ভার কিছুমাত্র কম নয়। শুধু হেফাজত নামধারীরা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র বিরোধী, একথা যারা ভাবছেন, খুব ভুল ভাবছেন। স্বয়ং সরকারি দলের সমর্থক, যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন দলীয় চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে নয়, বরং রোদে-জলে সরকারের পরিপুষ্ট ছাতার তলায় নিরাপদে দাঁড়িয়ে আম-কাঁঠালে উদরপূর্তি করার জন্য, ইতোপূর্বে যেমন তাদের মুখ থেকে ‘মালাউন’ ডাক শুনেছে হিন্দুরা, তেমনি আজও তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় বাধা দিচ্ছেন।
না, তাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে নয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান পদে আসীন হয়ে তারা সরকারের আইন অমান্য করছেন। কারণ তারা এ ধরনের ‘অপসংস্কৃতি’তে বিশ্বাস করেন না এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে তারা এসব প্রশ্রয় দেবেন না। দেশের সবাই ভুল পথে হাঁটলেও, তারা তো আর একই ভুল করতে পারেন না।
আমার প্রশ্ন, প্রতিষ্ঠানটি কি আপনার পৈতৃক সম্পত্তি? যদি তা না হয়, তাহলে আপনার ব্যক্তিগত কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠানের সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আপনাকে কে দিল? প্রতিষ্ঠানটি কি ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? প্রতিষ্ঠানটিতে কি ১০০% ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ আপনার মতে বিশ্বাসী?
আপনার বিশ্বাস যদি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে অন্যায় বলে দাবি করে, আপনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ না করতেই পারেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে বাধা দিতে পারেন না। সরকারি এবং সরকার অনুমোদিত সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকার প্রণীত আইন মানতে বাধ্য। পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার দুঃখে আহাজারি করা কুলাঙ্গারকেও কোনো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূ্র্ণ পদে আসীন হলে ২৬শে মার্চ প্রতিষ্ঠানটিতে পতাকা উত্তোলন করতে হয়।
আপনার বিবেককে প্রশ্ন নয়, আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্টোরেজে সার্চ দিন। দেখুন, আইন কী বলে। আপনার বিবেকের কাছে দেশ, জাতি, সরকার কিছুই আশা করে না। লিখিত সংবিধান আপনাদের জন্যই করা।