এবার একটু ‘ফসল মামণি’দের কথা বলি

রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা:

বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী জেমস্ এর গানটি মন দিয়ে পড়ি (না শুনে) প্রথমে-

এই দিদিমনি দিদিমনি সেলাই দিদিমনি

ছল ছল চোখে সেই দিদিমনি

দিদিমনি দিদিমনি সেলাই দিদিমনি

এই শহরে তোমার পাশে আমিও যে থাকি

লাল টুকটুক সেলাই দিদিমনি

দিদিমনি নিও তুমি আমার ভালবাসা

তোমার চোখে দেখি আমি রঙ্গিন দিনের আশা

লাল টুক টুক দিদিমনি

লাল টুক টুক দিদিমনি

উদয় অস্ত খাটো তুমি ঝরাও দেহের ঘাম

মহাজন দেয় কি তোমার ঘামের সঠিক দাম

কখনো তুমি শিল্পী আর কখনো তুমি নারী

কখনো তুমি প্রেমিকা আর কখনো তুমি প্রতিবাদী

চলতি পথে তোমার সাথে যখনি হয় দেখা

ইচ্ছে করে শুধাই তোমায় মনের দুটি কথা

কার লাগিয়া ছল ছল কাজল দুটি আঁখি

কেউ কি তোমায় কথা দিয়ে কথা রাখেনি?

….. কী সুন্দর গানের কথাগুলো তাই না!

আচ্ছা গার্মেন্টস্ এর মেয়েদের নাম সেলাই দিদিমনি কে দিয়েছিল? সবার আগে কে তাদের এই রকমভাবে অনুভব করেছিল? জানি না। তবে ওদের প্রতি সমাজের মানুষদের যে কী তীব্র অবহেলা ছিল তা অনেকগুলো দিন অনেক কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ হয়েছে আমার। এখনও যেখুব বেশী পরিবর্তন হয়েছে তা বলা যাবে না। নীতি নির্ধারকেরা ওদের নিয়ে ভাবতে হয়তো বাধ্য হয়েছে খানিকটা তাদের কাস্টমারদের চাপে পড়ে। 

আমার আজকের লেখা সেলাই দিদিমনিদের নিয়ে না। মুখে খাবার তুলে দেয় তো মায়েরা। তাই ফসলের সাথে সংশ্লিষ্ট এই সব নারী শ্রমিকদেরফসল মামনিনামটা হয়তো কোন একদিন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি দিয়ে ফেলতেও পারে। আমার কল্পিত নামের এই মামণিদের নিয়েই আজকের লেখা।

এই শ্রেণী আমাদের মতো কৃষি নির্ভর দেশের গ্রামে গঞ্জের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। দেশের যে জেলাগুলোতে বন্যা প্রবণতা কম তার মাঝে প্রথমদিকেই থাকবে মনে হয় নড়াইল জেলা। আমার ছোট বেলায় যে দু একবার একটু মাঠে তুলনামূলক বেশী পানি উঠতে দেখেছি, প্রত্যেকবারই দাদীদের চিৎকার করে বলতে শুনেছি, “বন্যা তো হবেই। কোন বিধিনিষেধ না মানে বাড়ির বিটি (নারী) রা সব ঢ্যাঙ্গা পাড়তে পাড়তে বিলি (মাঠে) চলে যাবে। বিটি মানুষ যে বিলে পারাখে সে বিলে বন্যা, খরা, ফসলহানী না হয়ে যায়?” অথচ রবি শস্য থেকে শুরু করে এমন কোন ফসল নেই, যা আমাদের কাজলা বিলে ফলতো না।

আজ অনেক বছর পরে এসে দেখে ভালো লাগলো যে সেই কুসংস্কারের দিনগুলো পার করে এখন নারীরা সমানে ফসল ফলানো প্রসেসিং এর সকল প্রকার কাজে অংশ গ্রহণ করছে। মাঠে গরু বাঁধছে। মেশিনের তেলের কনটেইনার নিয়ে ছুটে যাচ্ছে জমিতে পানি দিতে। জমিতে ধানের চারা রোপন করছে, আগাছা নিংড়াচ্ছে। এতে যদিও তাদের পরিশ্রম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।

গৃহস্থ পরিবারের নারীরা না হয় তাদের নিজেদের পরিবারের জন্য কাজ করে। কিন্তু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এবং পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে তাদের থেকে কম পারিশ্রমিক পেয়েও পুরো একটা সংসার চালানোর মতো কঠিন কাজ করে চলেছে কিছু ফসল মামনিরা। এদের নিয়ে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়তো হচ্ছে, তবে তা সংখ্যায় অনেক কম। এদের নিয়ে হয়তো লেখাও হচ্ছে, তবে সেটাও খুব বেশি না। 

আসলে কৃষি নির্ভর আমাদের এই দেশে সমগ্র কৃষকদের নিয়ে কথা বলার মানুষই তো খুব কম। সেখানে নারী কৃষি শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলার মানুষ আরও কম হবে, এটা ধরে নেয়াই যায়।

অনেকদিন পর গত নভেম্বরে দীর্ঘ পনের দিনের জন্য বাড়ী গিয়েছিলাম। তখন পুরোপুরি ফসলের সময়। সেই কাক ডাকা ভোরে ধান মাড়ানো মেশিনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বারান্দায় এসে দেখি দুই পাশের বিশাল ধানের মাঝে মেশিন চলছে, কিন্তু যারা চালাচ্ছে তাদের প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বুঝলাম, আগের দিনের দেখা বিশাল সাইজের ধানের পালা মাড়াই এর কাজ শুরু করেছে।

বাড়ীতে আম্মার কাজ করে যে দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন, সেসহ আরেকজন এখন সারাদিন এই কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় এদের মজুরী জনপ্রতি ১০০ টাকা কম হওয়ায় এবং কাজ বেশী পাওয়াতে এদের ব্যাপক চাহিদা। আমাদের পুরো পাড়ার কাজ নাকি এরাই সামাল দেয়। পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ সব পাড়াতেই এই রকম কিছু ফসল মামনিরা কম পারিশ্রমিকে তাদের শ্রম বেঁচে সংসার চালায়। এই বিষয়টা আমার কাছে খুব ভালো লাগলেও, কম পারিশ্রমিকের বিষয়টাতে মন খারাপ হলো। সব জায়গাতে নারীদের প্রতি কেন যে এতো বৈষম্য!

ছেলে নিয়ে গেছি, তার উপর আম্মার সহকারী চাচাতো বোনটা আসে সেই রাতের বেলা। রান্না বাড়া খাওয়া সব ব্যবস্থা নীচ তলায়, থাকি দোতলায়। মহা বিপাকেই পড়লাম। আম্মাকে বললাম, ওকে বলেন, দিনে যা পায় তার থেকে একশ টাকা আমি বেশী দিব। যে কয়দিন থাকি, ওর বাইরে কাজ করতে যাওয়ার দরকার নেই।  

রাতের বেলায় ও আসার পর আম্মা বলায় আমার কাছে এলো। আমার মতো পরের ধনে পোদ্দারি করা, টাকার জ্বালায় মরা টাকাওয়ালার মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বললো, আপনার টাকায় না হয় আমার চলে যাবে। কিন্তু আমার সাথে যে কাজ করে সে খাবে কী? দুইজন না হলে তো কাজে নিবে না। মেশিন চালাতে দুইজন লাগে। একজন পুরুষের সাথে সে কাজ করতে পারবে না। চাচাতো বোনটার কথা শুনে নিজেকে খানিকটা ছোটই মনে হলো। যেটা ভেবেছে আমি সেটা ভাবিনি বলে। 

বিষয়টা মাথায় থেকে যাওয়ায় পাশের গ্রামের ফুফুর বাড়ি যাওয়ার পথে স্কুলের এক বন্ধুর কাছ থেকে তাদের গ্রামের ফসল মামণিদের খোঁজ নিলাম। একই কথা বললো। সেই কাজ বেশী, পারিশ্রমিক কম থিওরিতে এই গ্রামেও ফসল মামণিরা কাজ করে এবং সংসার চালায়।

ঢাকায় ফিরে লিখবো ভেবেছিলাম, আবার ভুলেও গেছিলাম। কিন্তু চার মাস পরে আবারও যশোরের একটা গ্রামের ফসল মামণিরা আমাকে তাদের কথা স্মরণ করতে বাধ্য করলো।

ছেলেমেয়ে রেখে বাইরে বের হতে পারি এমন বিশ্বস্ত একজন মানুষের খোঁজ করছি অনেক দিন থেকেই। আগের দিনগুলোতে যেখান থেকে আনতাম, আইলার পরে বিভিন্ন এনজিও তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়ায়, এখন আর সেখান থেকে কাউকে পাওয়া যায় না। তবুও ভালো যে, তাদের অভাব অনটন কেটে গেছে। তাই গিয়েছিলাম বান্ধবীর গ্রামে। গিয়ে শুনলাম, এখন সবাই মিল কারখানায় কাজ করে। বাকিরা মাঠে জন দেয় (শ্রম দেয়)  সাথে আরেকটা জিনিস জেনে ভালো লাগলো যে, এরা যেহেতু এখন ব্যাপক পরিসরে আয় করছে, সেহেতু হাজব্যান্ডরা বা বাবারা এখন আগের মতো যখন খুশী তখন তেড়ে গিয়ে গায়ে হাত তুলতে সাহস পায় না।

যেভাবেই হোক নারীরা স্বাবলম্বী হলে যে তাদের উপর শারীরিক নির্যাতনের হার কমে, এটাও একটা খুশীর খবর বৈকি! না হয় না পেলাম আমি বা আমরা, আমার বা আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড!

বেশ তৃপ্তি নিয়ে মনে মনে বললাম, ভালো থাকো ফসল মামণিরা। স্বাবলম্বী হোক নারীরা। নারী নির্যাতনের হার কমুক। সমৃদ্ধ হোক বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.