মারজিয়া প্রভা:
এবছর বইমেলা যাবার আগে কোন এক ফেসবুক পোস্টে কথা হচ্ছিল, শেষ কবে বইমেলার কোন নতুন লেখকের বই পড়ে হৃদয় মুচড়ে গেছে? খুঁজে খুঁজে বের বের করলাম, হরিশংকর জলদাস যেবার প্রথম “রামগোলাম” বইটি লিখলেন সেবারেই বোধকরি শেষবারের মতন নতুন কোন লেখককে খুঁজে পেয়েছিলাম। এমন লেখক যে বইমেলাকে হাইলাইটে রাখতে পারে।
বইমেলায় পাঠক এর চাইতে লেখক বেশি! এমন নাকি হরহামেশাই শোনা যায়। মাঝে মাঝে সেগুনবাগিচায় এমন অনেক লেখকদের সঙ্গেই আড্ডার খাতিরে দেখা হয়, যাদের বই তিন চারবার এডিশনে বের হয় এক বইমেলায়। তাঁদের প্রচুর কাটতি বাজারে। আমি কোন এক অজ্ঞতার কারণে তাঁদের নাম চিনি না। কিন্তু আমার অজ্ঞতা হরিশংকর জলদাসকে ঠিকই চিনিয়েছিল জাত লেখক হিসেবে।
লেখকের ‘রামগোলাম’ বইটি ছিল হরিজন সম্প্রদায় নিয়ে। তিনি নিজেই প্রান্তজন কমিউনিটি থেকে উঠে আসা মানুষ। তাই তার লেখায় প্রান্তজনের জীবন আচার ধরা পড়ে অন্য আঙ্গিকে। এটা অন্য কোন লেখকের পক্ষে সম্ভব না। খুব স্বাভাবিক, একজন মানুষ যা বিশ্বাস করে, যা তার আশপাশে দেখে তাই উঠে আসে লেখনীতে। আর পাঠক তা পড়ে সে স্থান, কাল এবং লেখকের দর্শনকে কল্পনা করে। আমি রামগোলাম পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। এ কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই।
কিন্তু সম্প্রতি আমার মোচড় দেওয়া নতুন লেখকের প্রায় নতুন এক বই পড়ে আমি ধাক্কা খাই। শুধু ধাক্কা বলবো না, রীতিমতো আমি আশাহত হই। কারণ আমি লেখকের যে দর্শন প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে আমার খুশি হবার কিচ্ছু নেই।
বইয়ের নাম “এখন তুমি কেমন আছ?”। প্রকাশকাল ২০১৫ সাল। বিখ্যাত প্রথমা প্রকাশনীর এই বই এবার বইমেলাতেও ছিল। এবং আমার বান্ধবী বইটি কিনে আনে। সেইসূত্রে আমার সম্প্রতি এই বই খুটে খুটে পড়া।
উপন্যাসের প্লট খুব আহামরি কিছু না। ৩৪ বছর পর তমোনাশ ফোন দেয় প্রাক্তন প্রেমিকা বহ্নিকে। বহ্নি তখন দুই মেয়ের মা, স্বামী নিয়ে সংসার। প্রায় তিন যুগ পর পুরানো প্রেমিকের ফোন পেয়ে উথালপাতাল করে বহ্নির বুক। কী হবে এই উথালপাতালের পরিণতি?
এরকম প্লট নিয়ে কয়েক ডজন দেশি বিদেশি গল্প আর সিনেমা পড়েছি। তবুও “হরিশংকর জলদাস” এর বই বলেই এক অমোঘ আকর্ষণে পড়া শুরু করি। কেন পড়লাম এই নিয়ে এখন মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করছে!
বিয়ের আগে তমোনাশ এবং বহ্নি এক রাত কাটিয়েছিল বহ্নিদের বাসায়। এই ঘটনাকে উল্লেখ করে লেখক বলে, “একজন নারীর যে মহার্ঘ্য, সেটা নিয়ে বীরেন্দ্র (বহ্নির স্বামী) এর ঘরে সে (বহ্নি) আসেনি”। এর পরের অনুচ্ছেদে লিখেছেন, যখন তমোনাশের কথা মনে পড়তো, “কিছুই করতে ইচ্ছে করতো না তখন। অপবিত্র দেহটা বারবার বীরেন্দ্র’র হাতে তুলে দিতে তার বড় ঘেন্না লাগতো”।
নারীর মহার্ঘ্য কী জিনিষ? কিংবা অপবিত্র দেহ হয় কী করে? এসব নিয়ে লেখক খুব বেশি ভাবেননি। হুট করে যখন ভেবেছেন তখন সরলীকরণ করেছেন, নারী বা পুরুষ দুইজনেই বিয়ের আগে শরীর দেওয়া অপরাধ, এরকম কিছু লাইন দিয়েছেন।
কিন্তু তবুও আমার বোধগম্য হয় না, নারীর মহার্ঘ্য জিনিষ কী? শরীর? সতীপর্দা? ভ্যাজাইনা? একটা নারী কেবল শরীর হরিশংকর জলদাসের কাছে? তার কাছে একটা মেয়ে অপবিত্র কেবল বিয়ের আগে অন্যের সঙ্গে একরাত কাটিয়েছে বলে? পবিত্র-অপবিত্র নিয়ে হরিশংকর জলদাসের জ্ঞান টনটনা, দেখছি!
সবচেয়ে মজা লেগেছে, বহ্নি বা তমোনাশের মতো চুপিচুপি প্রেম নয়! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হাশেম-ডলি জুটির খুল্লামখুল্লা প্রেমকে স্বাগত জানিয়েছেন লেখক। কারণ লেখা থেকেই জানলাম, তারা কয়দিন পরেই বিয়ে করবে এটা ঠিকঠাক। হাশেম আর ডলির বিয়ে করার সম্ভাবনা না থাকলে, সন্দেহ নেই যে ডলিকেও অপবিত্র বলতো লেখক।
তবে সবচেয়ে নোংরা লেগেছে বহ্নির মেয়ে দীপাকে দিয়ে কিছু পুরুষের কথা বলানোর জন্য। লেখক অনেক ভেবেই এক নারীকে দিয়ে এসব কথা বলিয়েছে, যাতে তার পাঠকেরা রায় দেয়, “বাহ, দীপার মতো কথা বলা মেয়েরাই ভালো! আর অন্যগুলো সব অপবিত্র, নষ্ট”।
দীপার সঙ্গে দীপঙ্কর যখন ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তখন দীপা দীপঙ্করকে জিজ্ঞেস করে, “গোলাম মুরশিদ কে চেনো”?
- তার হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নামক একটি বই আছে। ওই বইয়ে তিনি লিখেছেন “ বাঙালি মেয়েরা স্বভাবত রক্ষণশীল। বিয়ের আগে, সামান্য দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, কোনো বাঙালি মেয়ে বিবাহ পূর্ব যৌন জীবনযাপন করে না। পরবর্তীতে ওই গোলাম মুরশিদ তার প্রকাশককে বলে রেখেছেন, কথাটি বদলে দিতে। কারণ বর্তমান বাংলায় মেয়েরা বিবাহ পূর্ব যৌন জীবনযাপন করে। কেবল যাপন করে না, রীতিমতো উদযাপন করে”।
তো যৌন জীবন তো উদযাপনের জিনিষ-ই!
হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি বলে, বাঙালি পুরুষদের বহুগামিতার কথা। আমার বড় দাদারও দুই বউ ছিল। আমি কোনো পরিবার খুঁজে পাইনি, যেখানে কোনো না কোনো জেনারশনের পুরুষ একসাথে দুই বউ না রেখেছে। অনেকে আবার জমিজমা বেশি থাকলে চার বউ পেলেছে একসঙ্গে। এশিয় কনফুসিয়াস মতবাদ অনুযায়ী, এই অঞ্চলের মেয়েরা তাদের সতীত্বকে জীবনের চাইতে বড় মনে করে! কিন্তু কেন করে?
কারণ এশিয়ার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাস্টম এবং এখানে জন্ম নেওয়া বা আগত কোন ধর্মই নারীকে যৌন জীবন উপভোগ করার জায়গা দেয়নি। বরং নারীকে তার যৌন জীবন নিয়ে লজ্জায় থাকতে বলেছে। নারীর শরীর এই অঞ্চলে তাই চিরন্তন পুরুষের দখলদারি থেকে গেছে। আর তাই গোলাম মুরশিদ এবং হরিশংকর জলদাসরা অসহায় হয়ে পড়ে তখন, যখন পুরুষের দখলদারি থেকে নারীরা নিজের শরীর বের করে এনে উপভোগ করে।
ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলে শরীর দেওয়া-নেওয়া হতেই পারে। সেক্স জিনিষটা ভাত-মাছ খাবার মতো স্বাভাবিক একটা জিনিষ। শুধু শাস্ত্রীয় কতক বুলি বলে আর কাগজে ফটাফট সই করলেই সেক্স পবিত্র হবে, না হলে অপবিত্র হয়ে যাবে, এমন কে কথা কবে শুনেছে? কই হাগুমুতু করার জন্য তো কোনো কাগজে সইয়ের দরকার পড়ে না!
না ভাই এবং বোনেরা, আপনি উল্টো বুঝবেন না, আমি বিয়ের আগে সবাইকে যৌন জীবনযাপন করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি না। এটা সবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে করবে, সে করবে। যে করবে না, সে করবে না। কিন্তু কেউ করলে তাকে ‘অপবিত্র শরীর’ ট্যাগ লাগানো হবে এটাতে আমার আপত্তি।
হরিশংকর জলদাসের পুরো উপন্যাসটা অনেক আগেই পড়া থামিয়ে দিতাম। শুধু পড়ে গেছি, এক মেয়েকে কতোটা অসহায় করে তুলেছে লেখক। শুধু কোন রাত্তিরে সে একটু আনন্দ করে প্রেমিকের সঙ্গে থেকেছিল বলে! বলিহারি হরিশংকর মশাইকে! নারীর ভার্জিনিটির কী বিশাল সার্টিফিকেটই না দিয়ে দিলেন!
লেখক বড় প্রিয় ছিল বলে ধাক্কা খেয়েছি। নাহলে এরকম আবোল তাবোল তো রোজ কত অশিক্ষিত লোকেরাই বলে! কে ধরে তাদের কথা! কিন্তু একজন সমাজ বদলানো লেখক যদি এই কথা প্রচার করতে চায়, তখন দেয়ালে মাথা ঠুকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।