সুচিত্রা সরকার: রাগ যখন চরমে, বিষন্নতা যখন চৌকাঠ পেরোয়, বড় ক্লান্ত লাগে। মনে হয়…। তারপর ঘুরে দাঁড়াই। বা দাঁড়াই না। সামলে উঠি অথবা ভয়ে শিউরে! তবু বড় মায়া! জীবন মানে উৎসব! তাই কেউ যখন নিজ থেকে জীবনের বাতি নিভিয়ে দেয়, মানুষটার জন্য মন কেমন করে! চলে যাওয়া মানুষটার দুঃখকে দুহাতে স্পর্শ করি!
মায়ের জ্যাঠাতো ভাইয়ের বউ, মায়া মামী। খুব সৌখিন। চুলে উঁচু খোঁপা। টকটকে লাল সিঁদুর। মলিন শাড়িটাও বেশ কৌশল করে পরা চাই! আর মন্টু মামা চিরকেলে ভাদাইম্যা! তাস খেলে। বিড়ি টানে! আলসেমি আর কুঁড়ের বাদশা! মামীর রোজগারে ভাত খায়!

মামী বৈঠকখানার একটা অংশে, পান-বিড়ির দোকান পেতে বসেন। ছ’টা প্রাণ তো বাঁচাতে হবে! তাই দিয়ে ঠেলেঠুলে কোনোমতে ছোট ছোট সন্তান আর বৃদ্ধ শাশুড়ির ভরণপোষন! তবু সংসার চলে কই!
মামী ঋণ নেয় এনজিও থেকে। তারপর আবার শোধ! আবার ঋণ। চক্রাকারে বাড়ে ধার- দেনা! এমন যখন চলছে, হঠাৎ একদিন এনজিও কর্মী হাজির! সুদের টাকা না দিলে ঘরের খাট খুলে নিয়ে যাবে! মামীর খুব অপমানে লাগলো! দুই মাইল পায়ে হেঁটে বাজারে গিয়ে কিনলেন ইঁদুর মারার বিষ।
মামী আর নেই, এই শুনে যখন বাড়ি গেছি, নানামুনির নানা মত। পশ্চিম পাড়ার কাকলী বললো, মামীকে বমি করানোর চেষ্টা করছিল সদর হাসপাতালের ডাক্তাররা! মামী শুধু বলছিল, আমারে মরতে দ্যান! তারপর শেষবার নিজের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বুকে ঘুষি মেরে বলেছিল, শালার জীবন যাস না ক্যান!
ব্যাস! এক চাপড়েই মামী শেষ!
খুব ভেবেছি! জীবন কত বিস্বাদ হলে, মরণের দরজায় গিয়ে জীবনের দিকে ফিরে তাকায় না মানুষ!
সেবার খুব চেষ্টা করেছিলাম মামীর খবরটা পত্রিকায় বের হোক। এনজিওগুলোর চেহারা সবাই দেখুক! কোনো পত্রিকাকে রাজি করাতে পারিনি! সকলেই জিজ্ঞেস করছে, স্ক্যান্ডাল আছে? ওহ নেই? এনজিও সুদ নিয়ে ঘটনা? কোন এনজিও? ওরে বাবা! পিছিয়ে গেল সকলে। তারপর খুব চেষ্টা করে কুমিল্লার আঞ্চলিক একটি পত্রিকায় ঘটনাটা ছাপা হলো। এক কলাম, এক ইঞ্চি! স্ক্যান্ডাল নেই, রগরগে সিন নেই, মামীর গ্ল্যামারও নেই। বাজারে এ খবর চলবে কেন? এমন যদি হতো! মামী যদি মিথিলা হতেন!
দ্বিতীয় ঘটনা এই কিছুদিন আগের। শরিয়তপুরের একটা ষোলো বছরের মেয়ে। বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক দেবার কথা ছিল তিন ভরি সোনা! কনেপক্ষ কথা রেখেছিল। মেয়ের বিয়েতে তিন ভরি গয়নাই দিয়েছিল। স্বচ্ছল পরিবার। গায়ে লাগেনি। আর ওদিকে বরপক্ষ বেশ গরীব!
বছরখানেক পরে কী একটা অছিলায় মেয়ের মা গয়নাগুলো রেখে দিল নিজের কাছে! এবং আর ফেরত দিল না! ওদিকে এই গয়নাকে কেন্দ্র করে অশান্তি বাড়ে! মেয়েটিও একদিন শ্বশুড়বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে এসে সিলিং এর ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়ে! তিন বছরের কন্যাশিশুকে রেখে।
বর, ননদ, শ্বশুড়-শাশুড়ি ভয়ে গ্রাম ছাড়ে! পুলিশ মামলা নিতে চায় না। বাবার বাড়িতে আত্মহত্যা, শ্বশুড়বাড়ির লোকজনের নামে কীভাবে মামলা করবে? খুব চেষ্টা করেছিলাম একটা প্রতিবেদন ছাপাতে। তাহলে হয়তো টনক নড়তো প্রশাসনের। মামলা হতো। দোষী পুরুষতন্ত্র কিছুটা হলেও শাস্তি পেত! দিন পনেরো পর বরপক্ষ নিজেদের বাড়ি ফিরে গেল। আর এতোদিনের বাসি সংবাদ কি আর গণমাধ্যমে আসবে?- এই যুক্তিতে সংবাদকর্মী বন্ধুরাও পিছপা হলেন। মেয়েটার জন্য পত্রিকার পাতায় এক কলামও জুটলো না! এমন যদি হতো! মেয়েটির নাম যদি হতো জ্যাকুলিন মিথিলা!
প্রতিদিন কতো মেয়ে আত্মহত্যা করে! তার কটা খবর সংবাদ মাধ্যমে ঠাঁই পায়? পায় না সবাই। কারণ সেসব মৃত্যুর সংবাদমূল্য বর্তমান বাজারে জ্যাকুলিন মিথিলার চেয়ে কম! হোক তাদের যন্ত্রণা জ্যাকুলিনের চেয়ে বেশি!
আজ কদিন ধরে খবরটা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছেই না। অমুক পত্রিকা, তমুক অনলাইন, ফেসবুকের পোস্ট! সবখানে জ্যাকুলিন মিথিলা! বেঁচে থাকতে মেয়েটা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিল আলোচিত হতে। মরে গিয়ে খবরের শিরোনাম হলো। পার্থক্য একটাই। বেঁচে থাকলে ওর ভিডিও-রগরগে ছবি যারা লুকিয়ে দেখতো, আজ তারাই ছিঃ ছিঃ করছে। ধোয়া তুলসীপাতা সব! আর এই তুলসীপাতাদের জন্যই মিথিলার পোস্ট এর ভিউয়ার পঞ্চাশ হাজার ছাড়ায়।
বাইশ বছরের একটা মেয়ে দুম করে মরে গেল! এটা খবর নয় গণমাধ্যমের কাছে। খবর এটাই, মেয়েটা নিজেকে সানি লিওনের সঙ্গে তুলনা করতো। ফেসবুকে শেয়ার করতো অর্ধনগ্ন ভিডিও! সিনেমার আইটেম গানে নাচতো।
খবর এটাই, পোশাকটা মিথিলার বড্ড খোলামেলা। গণমাধ্যমের ভাষায় সাহসী পোশাক। এই ‘সাহসী পোশাকের’ মানে কিন্তু পোশাকের সঙ্গে ঢাল-তালোয়ার বা পিস্তল বন্দুকের যোগাযোগ নয়। এই সাহসের মানে পুরুষের যৌনচিন্তায় সুড়সুড়ি দেয়া পোশাক! পুরুষের মনোরঞ্জন। টিআরপির ঊর্ধ্বগতি!
মেয়েটা নিজের মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে বড় হতে চেয়েছিল কিনা, জানি না। জানি এই, জ্যাকুলিনাও জেনেছিল, সানি লিওনের বড় কদর পুরুষতন্ত্রের শিল্পমাধ্যমে! পর্ন তারকা সেখানে, দিব্যি নায়িকা বনে যান! হলে সানি লিওনকে দেখতে লাইন পড়ে টিকেট কাউন্টারে! যে যতো খোলামেলা আর ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ করতে পারেন, তার ক্যারিয়ারের ভিত ততোটাই পোক্ত হয়! সানি লিওনকে দেখে মিথিলা এটা বুঝেছিল ঠিকই!
খুব কি ভুল বুঝেছিল? সানি লিওন কাদের সৃষ্টি? কারা দেখে? কারা ওর সিনেমার টিকেট কেনে? কারা হাততালি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যায়? মিথিলা তাদেরকেই ওর টার্গেট অডিয়্যান্স করে নেয়। নারীর পণ্যায়নের বাজারে ওর ছকটা কি ভুল? উত্তরটা পুরুষতন্ত্রের জন্য তোলা রইলো!

হঠাৎ বদলে গেল চেনা মানুষ। শুরু হলো শ্বশুর বাড়ির চিরাচরিত মানসিক নির্যাতন! ভাবতে আশ্চর্য লাগে, শ্বশুর ঘরের নির্যাতনটা সাধারণ মেয়েকে যেমন নাজেহাল করে, ‘সংসারের ব্যকরণে’ উল্টোপথে চলা মেয়ের জীবনটাও কী অবলীলায় সাঙ্গ করে দেয়!
স্যালুট গঞ্জনা! স্যালুট মানসিক নির্যাতন। স্যালুট মিথিলার বর!
যে গণমাধ্যম এত হড়বড় করে মিথিলার ‘ইতিবৃত্ত’ ঘাটছে, কই তাদের তো দেখছি না প্রশ্ন তুলতে! তারা তো বলছে না, আজ এতোদিন হয়ে গেল, মিথিলার স্বামী ধরা কেন পড়েনি? কেন শাশুড়ি মিথিলাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন? কী শাস্তি হতে পারে ওদের! কেন বিয়ে করেছিল? উৎপল কেন স্ত্রীকে মর্যাদা দিতে পারেনি নিজের বাড়িতে!
গণমাধ্যম এসব বলবে না! ওসব কারণ সকলে জানে। পুরুষতন্ত্রের গণমাধ্যমগুলো তো বটেই। সেই এক গল্প। নারীর জীবনের লাঞ্ছনা। পুরুষতন্ত্রের যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখা বঞ্চনা। নারীর মর্যাদাহীনতার গাঁথা! ওসব বললে, কাটতি বাড়বে না। কাটতি বাড়ে, নারীকে বাঁচিয়ে রেখে পুরুষের বিনোদন করলে। কাটতি বাড়ে, মরে যাওয়া নারীর কফিন থেকে ‘নিষিদ্ধ জীবন’ তুলে আনলে। আর তাতেই পুরুষতন্ত্রের ‘যুপকাষ্ঠে’ আটকে থাকে নারীমুক্তির স্বপ্ন!
৯.২.২০১৭
১১.৩৬ মিনিট
লালবাগ, ঢাকা
শেয়ার করুন: