আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বনাম বাঙালি হেডম

ফারদিন ফেরদৌস:

প্রথমেই আমরা একটা শ্লোক বলে নেই।
আওমীগণের পতন দেখিয়া নিজেরে না বদলান
শেখ হাসিনার কপাল তাহাদের লিখিবেই আসমান

প্রতিবাদীর মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার দুর্মর বুদ্ধি বিগত সরকারের। সারাদিন যাদের নিন্দায় কলম ভাঙ্গেন, অথচ তাদের ফেলে যাওয়া ওই দুর্বুদ্ধিরেই আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। এইসব আপনাদের নবতর রাজনৈতিক বন্দোবস্ত? নিজেদের সুকৃতি না চিনায়ে ভিমরতিরে কেন দেখায়ে যাচ্ছেন?

কাউকে ক্ষুদ্র উপজাতি বলে বৈষম্য করেছেন। আবার তাদেরকেই আদিবাসী বলে মহিমান্বিত করবার প্রয়াস পাচ্ছেন। যাদের নিয়ে এই বিব্রতকর খেলাটা এই রাষ্ট্রযন্ত্র খেলে চলেছে, সেই অদ্ভুতুড়ে খেলার দায় কী করে চাপাতে পারেন ওই ঘুঁটির ওপর? বাঙালি বলে আপনার এত হেডম, তবু পতন কেন ঠেকাতে পারেন না? এই ভূমিতে অধিষ্ঠানের চিরকালীন বন্দোবস্ত ধরে রাখতে পারেন না? বস্তুত নিয়ম এটাই। আপনি ও আমি কেউ থাকব না। রয়ে যাবে কেবলই কর্ম। ওই ‘কর্ম’টারে সুপথে পরিচালিত করেন।

আজকের প্রথম আলো লিখেছে, পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা ও না রাখা নিয়ে দুই পক্ষের কর্মসূচি চলাকালে হাতাহাতি এবং পরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ বলছে, তাদের ওপর হামলা করেছে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামের একটি সংগঠন। হামলায় অনেকে আহত হয়েছেন।

যথারীতি স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দায় স্বীকারের সংস্কৃতি ৫৪ বছর ধরেই বাংলাদেশ অনুপস্থিত।

পাঠ্যবইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী অখণ্ড ভারতের কল্পিত গ্রাফিতি সংযোজনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তিসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল সকালে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও করে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামের একটি সংগঠন। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একদল মানুষ পাঠ্যবইয়ে গ্রাফিতিটি পুনর্বহালের দাবিতে এনসিটিবির সামনে কর্মসূচি পালন করতে যান।

অতঃপর সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায় সভারেন্টিয়ানরা। হামলায় আহত হন ধনজেতরা, অনন্ত ধামাই, ফুটন্ত চাকমা, ইসাবা শুহরাত, রেংইয়ং ম্র, রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, ডোনায়ই ম্রো, শৈলী এবং ডিবিসি টিভির সাংবাদিক জুয়েল মারাকসহ ৯ ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে রুপাইয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য বলে ফেসবুকে এক পোস্টে জানান সংগঠনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি আরও বলেন, হামলা চালিয়েছে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘এই ঘটনার অবশ্যই বিচার হবে। দুইজন ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে।’

আমাদের এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংকট হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে কেউই নিজেদেরকে সার্বভৌম নাগরিক দাবি করবার ফুরসত পায় না। সব রেজিমেই কোনো না কোনো গোষ্ঠীর জন্য হেডমগিরি করবার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। ওই মাতাব্বরেরা লাঠিয়াল সেজে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর জিঘাংসা মেটায়। চরম প্রতিহিংসার কুৎসিত রূপ দেখায়।

পাহাড়ি ভাই-বোনদের বলব, যেই রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে। সংবিধানের চার মূলনীতির তিনটাই বাদ গেছে। সেখানে ‘আদিবাসী’ নামের একটা শব্দবন্ধ কারো জন্যেই আলাদা কিছু ম্যাটার করে না আসলে। জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে মানুষের আত্মমর্যাদা নিরূপিত হয় না। আপনার কাঙ্খিত মূল পরিচয় নিশ্চিত হয় আপনার কর্মে। কর্ম যার ভালো তাকে বাঙালি, সমতলী, পাহাড়ি বা আদিবাসী পরিচয় দিতে হয় না। আচরণে যিনি নিকৃষ্ট আদিবাসী পরিচয় তার মর্যাদা রক্ষা করতে আসবে না।

আমাদের সবার পরিচয় আমরা মানুষ। আমরা বাংলাদেশি। বাঙালি, আদিবাসী, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা, মুরং; এইসব পরিচয়ও থাকুক। তবে এইসব জাতিগত, দেশজ বা ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে মরণপণ উন্মাদনা তৈরির এতটুকু মানে নাই। কাউকে আদিবাসী সাব্যস্ত করলেও অন্যপক্ষের গায়ে ফোস্কা পড়বার কিছু নাই। আদিতে আমাদের পূর্বপুরুষরা কে কোথায় ছিলেন তা আমরা নিশ্চিত করে যেহেতু বলতে পারি না, কাজেই আমরা প্রায় সবাই অধিবাসী তথা Inhabitant-এর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কেউ কারো তুলনায় কম আদিবাসী তথা Aboriginal নই। কাজেই রাষ্ট্রের তরফে কাউকে আলাদা করে আদিবাসী তকমা দিয়ে বিভাজিত সমাজব্যবস্থা কায়েমের সুযোগ বারিত করাই যুক্তিযুক্ত। সবার এক বাঙালি নাম গ্রহণে বাধা থাকবে কেন?

মানুষ তার নিজের অধিকারের পক্ষে দাবিদাওয়া কেন জানাতে পারবে না? আপনি যে গোষ্ঠিকে ক্ষুদ্র বলে আত্মপ্রসাদে ভুগবেন, সেই গোষ্ঠিটার হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা ও মর্যাদাহানি তৈরিতে আপনি যে ভূমিকা রেখে চলেছেন, তার দায়ভার মেটাতে হবে না? আপনি অন্যের মনে যতটা আঘাতের কারণ হবেন, ঠিক ততটা প্রত্যাঘাত গ্রহণ করতে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। আমরা কেউই প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের বাইরে নই।

আমাদের দাবি, গতকালের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আমাদের রাষ্ট্র। প্রত্যাশা করি পাহাড়ে বসবাসরতদের জন্য ‘ক্ষুদ্র’, ‘উপ’ ও ‘আদি’ নামের অদ্ভুতুড়ে বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা নিয়ে ভালো থাকতে দিতে হবে। নিখাদ বাঙালিয়ানায় গ্রহণ করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা দিতে হবে।

হেডম শব্দের অর্থ হলো ক্ষমতা, বীরত্ব, হিম্মত বা দাপট। আঞ্চলিক এই শব্দটি সাঁওতালি বা মুন্ডারি ভাষায় ব্যবহৃত হয়। নৃগোষ্ঠীরা বীরত্ব প্রকাশের জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করতেন। এখন অবশ্য আমরা বাঙালি দাবিদারেরা শব্দটিকে একান্তই নিজেদের করে নিয়েছি।

২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। তাদের ভাগ্যলিপির সাথে অতি অবশ্যই আমাদের কপালের রেখাও এক ও অভিন্ন হতে হবে। ভাগ্যগুণে রাজধানী ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করলেই সে মোড়লগিরি করবার একচ্ছত্র লাইসেন্স পেয়ে যায় না। দেশের সকল মানুষের সমানাধিকার। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে রাষ্ট্র তার নাগরিকের ওপর কোনোরূপ বৈষম্য আরোপ করবে না -এটাই তার সাংবিধানিক ওয়াদা। নতুন বাংলাদেশের প্রতীতি ও প্রবিধানও আরো শক্তপোক্তভাবে হতে হবে এটাই।

লেখক: সাংবাদিক
১৬ জানুয়ারি ২০২৫

শেয়ার করুন: