নিজের সাথে দাঙ্গাল (কুস্তি) 

তামান্না ইসলাম: সকুলের ফেয়ারওয়েলের অনুষ্ঠান চলছে। সুমি অপলকে তাকিয়ে আছে স্টেজের দিকে। প্রথম শ্রেণীর লোপা আর মিত্রাকে মনে হচ্ছে বড়সড়ো দুটো প্রজাপতি, কী সুন্দর নাচছে সারা স্টেজময়। সেই প্রথম সুমি আবিষ্কার করলো, তার নাচ এতো ভালো লাগে। খুব ইচ্ছে করছে ওদের সাথে নাচতে।
কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তাদের পরিবার কিছু ব্যাপারে আর দশটা বাঙ্গালি পরিবারের মতোই রক্ষণশীল। মেয়েকে গান শেখানোতে সমস্যা নাই, কিন্তু নাচ শেখানোর কথা কেউ উচ্চারণই করেনি ছোটবেলায়। নাচ  যে নিষিদ্ধ, এটা যেন প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত। ছোট্টবেলায় যা ছিল নিষিদ্ধ, ক্লাস টেনে এসে সেকথা উচ্চারণ করলে বাসায় তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবে। সুমি খুব নিরীহ লক্ষ্মী টাইপ মেয়ে, তার একথা বলার সাহস নাই। তার উপরে সামনে এসএসসি পরীক্ষা। তাই বুকের ভেতরে তোলপাড় করা শখটাকে সে অনেক গভীরে কবর দিয়ে দিল। 
তামান্না ইসলাম

নিজের অনেক শখকে কবর দিতে, বড়দের কথা নির্বিবাদে মেনে নিতে সে অত্যন্ত পারদর্শী। ক্লাস সিক্সে যখন পড়ে, নতুন সকুলে ভর্তি  হলো। অনেক নতুন বান্ধবী হলো। বান্ধবীরা সবাই হালফ্যাশনের জামা পরে, সুন্দর সুন্দর হাঁটু পর্যন্ত জামা। সুমির গড়ন মাঝারি, দৈত্যাকৃতি নয়, তবে কিছুটা লম্বা। হটাৎ করে বাসায় আদেশ হলো পা ঢাকা কাপড় পরতে হবে।

বাবা-মা বুঝালেন ‘পায়ে ছোট ছোট পশম হচ্ছে, একদম ভালো দেখা যায় না।’ তখনো সালওয়ার-কামিজ নাই, তাই প্রচণ্ড গরমে পা ঢাকা মোজা পরে একদিন সে গেছে এক বান্ধবীর বাসায়। বান্ধবীর ঠোঁট কাটা মাতো বলেই ফেললেন, ‘তোমার গরম লাগে না?’ সেই কিছুদিন গেছে বটে। একদম ইচ্ছা করতো না ওরকম বেখাপ্পা পোশাক পরতে। সে ফ্যাশন না বুঝলেও এতোটুকু বুঝতো, তার পোশাক-আশাক অন্যদের চেয়ে আলাদা। সারাক্ষণ এই নিয়ে এক হীনমন্যতায় ভুগতো। 
‘মা আমি কিন্তু এবছরও নাচ করবো।’ লাবিবার কথায় সংবিৎ ফিরে পায় সুমি। লাবিবা, তার কিশোরী মেয়ে। নিজের শখ মেটেনি বলে ওকে অনেক ছোটবেলা থেকেই নাচে ভর্তি করিয়েছে। মায়ের জিন পেয়েছে মেয়েটা, নাচ খুব ভালোবাসে। এগারোতে পা দিয়েছে মেয়ে। কিন্তু  দেখায় চৌদ্দ। ওর বান্ধবীরা সবাই ধীরে ধীরে নাচ বন্ধ করে দিচ্ছে। কারো মা, বাবা বলছে ‘উঁচু ক্লাসে উঠছে, পড়ালেখার ক্ষতি।’
সুমি যদিও জানে মুল কারণট সেটা নয়। নিজের  মনটাও খুঁত খুঁত করে। স্টেজে এতোগুলো মানুষের সামনে নাচবে? যদি কেউ খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়? মা বলেছিল, ‘ছোটবেলায় এসবে দিচ্ছ, বড় হলে কিন্তু ছাড়াতে পারবে না।’ মায়ের কথাই সত্য হয়েছে। মেয়ের বাড়ন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে একবার বলতে ইচ্ছা করে ‘বাদ দে না এখন, অনেক তো হলো।’ কিন্তু মেয়েটার মুখটা এখনও একদম শিশুসুলভ, কিছুতেই ওকে কষ্ট দিতে পারে না সুমি। ক্লাস টেনের সুমিকে মনে পড়ে বড্ড। 
লাবিবাকে সুইমিঙে ভর্তি করিয়েছে সুমি। লাবিবা একটু ভয় পাচ্ছে মনে হলো। ও সাঁতার পারে, কিন্তু এটা সাঁতারের প্রতিযোগিতা। সেখানেই ওর ভয়। দিন-রাত কঠিন প্র্যাকটিস শুরু হলো। অনেক দোকান ঘুরে সুমি ওর জন্য পা ঢাকা, হাত ঢাকা পোশাক কিনে নিয়ে আসলো। দেখা গেলো লাবিবার ভয়টা অমূলক না। সে সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকে অনেকখানি। প্রতিদিন মন খারাপ, বাসায় এসে কান্নাকাটি চলছে নিয়মিত।
একদিন জাহিদ, লাবিবার বাবা গেছে ওকে প্র্যাকটিস থেকে আনতে। বাসায় এসে জাহিদ অবাক হয়ে সুমিকে বললো, ‘এটা কী কিনে দিয়েছো তুমি মেয়েটাকে? পানি চুষে ওটার ওজন হয়ে থাকে ওর নিজের ডাবল, ও এগোবে কীভাবে? তুমি তোমার মেয়েকে খুব ভালো করে চেনো, ও যা করে, সিরিয়াসলি করে। সাঁতার প্রতিযোগিতা যদি করতেই হয় ঠিকমতো পোশাক পরে করতে হবে।’ 
শুরু হলো নিজের সাথে যুদ্ধ। সে এক ভয়ানক যুদ্ধ। কীভাবে সম্ভব ওই সংক্ষিপ্ত পোশাকে সাঁতার কাটা? রাতের ঘুম হারাম। ‘থাক পানির নিচেই তো থাকবে।’ ‘বড় দেখে বাথ টাওয়েল পেঁচিয়ে একদম পুলের পাশে যেয়ে পানিতে নেমে যাবে।’ নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সাঁতারের সিজনটাই চলে গেলো, মেয়েটা সাঁতারের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। 
নাচের সাথে সাথে লাবিবার আরেকটি খুব খুব প্রিয় কাজ ফুটবল খেলা। খুব ছোটবেলা থেকেই তার ধ্যান জ্ঞান ফুটবল। গোল খেলে বাবা-মেয়ে দুজনেই মুখ হাঁড়ি করে বাসায় ফেরে। সবকিছুতে তর্ক করলেও বাবা যখন বল পাস না দিলে বা জোরে কিক না করলে বকা দেয়, সেই বকা মাথা পেতে নেয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় নিজের ভুল, প্রতিদিন নিজেকেই নিজে চ্যালেঞ্জ করছে। এগারো, বারোতে এসে আবারো বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো সেই পোশাক। বাঙ্গালি বান্ধবীরা ধীরে ধীরে হাফ প্যান্ট পরা ছেড়ে  দিয়েছে। হাজার হোক মায়ের মন, সেই সনাতনী রক্ষণশীল মন।
যেদিনই লাবিবার প্র্যাকটিস থাকে, সুমি মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ায়। জাহিদকে কিছু বলে কোনো লাভ হয় না, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় সব দুশ্চিন্তা। মেয়ে ভালো খেলবে এই স্বপ্নে সে বিভোর। মনের বিরুদ্ধে বাবা-মেয়ের এই সব অত্যাচার মেনে নেয় সুমি। ‘ফুল প্যান্ট পরে তো আর ফুটবল খেলা যাবে না।’ মন বলে ‘ফুটবল না খেললেই হয়। ফুটবল খেলে  হাতি ঘোড়া মারবে?’ মনই আবার উল্টো  যুক্তি দেয় ‘মেয়েটা খেলা বন্ধ করে দিলে একদম বাঁচবে না।’ 
‘মিসেস রহমান, আপনার কিন্তু হার্টের অবস্থা খুব একটা ভালোর দিকে যাচ্ছে না। আপনি যদি একদমই আমার কথা না শোনেন, আমার আর কিছু করার থাকবে না। আপনার যা অবস্থা শুধু খাওয়া আর ওষুধে হবে না, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ব্যায়াম করতে হবে। এক ঘণ্টা।’ ডাক্তারের গলায় কিছু একটা ছিল সেদিন। বহুবার ব্যায়াম করার কথা বলেছে আগে, তবে এবারের রিপোর্ট পেয়ে তার গলার আশঙ্কাটা সহজেই টের পাওয়া যায়। 
লাবিবার জোরাজুরিতেই আবার হার মানলো সুমি, মেয়েটাই এনে জিমে ভর্তি করিয়ে দিল মাকে। ‘আমি যে এসব মেশিন কিছুই চালাতে জানি নারে। সবাই যদি হাসে?’ ‘আমি আছি না মা। আমার কাপ মাসল দেখেছো? এক লাথি মেরে দেব।’ সগর্বে নিজের মাসল দেখায় লাবিবা। জিমের দরজা দিয়ে সলজ্জ মুখে মেয়ের হাত ধরে ঢুকছে সুমি। নিজের সাথে আজীবন কুস্তি করে সেই ভীতু ভীতু মনটাকে হারাতে পেরেছে শেষে, তাই সেই লজ্জার আড়ালে আছে কিছু তৃপ্তিও।
শেয়ার করুন: