চেনা অপরিচিতা: অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তাররা আমার সাথে সহজ আলাপ করে। অভয় দিয়ে বলে, স্পাইনাল কর্ডের ইঞ্জেকশনটার ব্যথার পর আর ব্যথা পাব না। আমার ইঞ্জেকশন পুশের পর আমার ডান পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরতে ধরতে আমাকে শুইয়ে দেওয়া হয়। আমার হাতে প্রেশার মাপার যন্ত্র বাঁধা। আমার খুব শীত লাগে। আমি শীতে কাঁপি। আমার ডাক্তার আসে।
আমি কোনকিছু অনুভব করি না, কিন্তু ড্রিল মেশিনের মত কিছু একটা বিজবিজ করতে থাকায় বুঝি আমার পেট কাটা শুরু হয়েছে। ডাক্তার আর নার্স মিলে আমার বাচ্চাটাকে পেট ঠেলে বের করে আনতেই কান ফাটিয়ে চেঁচানোর আওয়াজ পাই। এক মুহূর্ত দেখিয়ে ডাক্তার বলে, “এই দেখ, তোমার মেয়ে”। এক মুহূর্ত কি হতাশা ছোঁয়? ছেলেমেয়ে প্রেফারেন্স যে আমার নেই, তা নয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই, মেয়ে বাচ্চা আমার বেশি পছন্দ। কিন্তু আমার আত্মীয় পরিচিত জনেরা লক্ষণ বিচার করে বলেছিল, বা তাদের চাওয়াও হয়তো এমন ছিল যে, আমি একটা ছেলে বাচ্চা আনি।
আমাদের সমাজে ছেলের মায়ের কদর অন্যরকম। ঐ লোভটা কি ঢুকে গিয়েছিল? ঠিক জানি না। কিন্তু যখন পোস্ট অপারেটিভ রুমে আমাকে একটা চোখ ধাঁধানো বাচ্চাকে কোলে দিল, আমি শুধু ভাবছিলাম, এতো সুন্দর কেন? একটু কম সুন্দর হলেও তো আমি ভালবাসতাম।
মুগ্ধতা, মায়া, দুশ্চিন্তায় রূপ নিতে দেরি হল না। বাচ্চা ক্ষুধার্ত, কিন্তু আমার নিপল মুখে নিতে পারছে না। নার্স এসে টিপে টিপে যে দুধ বের করলো, তা এক চামচ হবে। তা দিয়ে তো ক্ষুধা মিটবে না। নার্সদের হা হুতাশ আর শ্বশুরবাড়ির মানুষের চোখে আসন্ন শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা আমাকে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকলো। ওসবও উপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু বাচ্চা দুধ খেতে পারছে না সেই চিন্তা আমাকে অসহায় করে দিল। সেই অসহায় সময়ে আমার স্বামীর চোখে আমার জন্য নেতিবাচক কিছু দেখিনি এবং আমাকে সহযোগিতা করার জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আমার ইনভার্টেড নিপল। ছোট থেকেই নিপল ভেতরে ঢুকানো। আম্মাকে জিজ্ঞাস করলে বলতো, অনেকের এমন থাকে। কিন্তু আমার খালা আর ভাই বলে, ছোটবেলায় আমার দুধ গালতে গিয়ে জিনিসটা প্রপার ওয়েতে করতে পারেনি। তাই এমন হয়ে গেছে। তাদের অযথা মিথ্যা বলার কারণ আমি খুঁজে পাইনি। এমনকি আমার মাও এক পর্যায়ে স্বীকার করেছিল যে, আমার নানীর কথায় সে এই কাজ করেছিল। তাতে নাকি বুক ছোট থাকে।
হাহ! আমার বেলায় শুধু হিতে বিপরীত হয়নি, বরং আমি মা হয়ে আমার বাচ্চাকে খাওয়াতে পারছি না, সেই নিদারুণ যন্ত্রণা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আরেকজনের অপরাধে আমি আর আমার বাচ্চা শাস্তি পাচ্ছি।
যখন কনসিভ করি, তখন ডাক্তারকে বললে, ডাক্তার কিছু ব্যায়াম দেয়। সেগুলো করাতে নিপল একটু বেরিয়ে আসে। কিন্তু ডেলিভারির পর আবার ঢুকে যায়। প্রথম তিনদিন এমনিতেই দুধ কম আসে, তার উপর বাচ্চা নিপল পাচ্ছে না। ক্ষুধায় বাচ্চা সারারাত কাঁদতো, আর তার ফুপু কোলে নিয়ে হাসপাতালের করিডরে হাঁটতো। আমি অক্ষমতায় কাঁদতাম।
দুদিন পর ডাক্তার এসে বাচ্চাকে দেখে বিলুরুবিন টেস্ট করতে দিল। ১৬ এলো। ১৪ এর কম হলে বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম। আমার বাচ্চাটাকে আইসিইউ –এ নিয়ে গেল। আমার পেটে তখন কাঁচা সেলাই। সেই সেলাই নিয়ে আইসিইউ যেতাম। অনেক বাচ্চা সেখানে। ওখানে দেবশিশুর মতো আমার বাচ্চাটা খালি গায়ে শুয়ে আছে দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠতো।
নার্সরা বলতো, “ব্রেস্ট ফিড করাবেন?”
আমি আমতা আমতা করে বলতাম, আমার নিপলে সমস্যা, আমি দুধ দিয়ে যাই…। সেই দুধও পর্যাপ্ত হতো না। তখন ওরা বাধ্য হলো পাউডার মিল্ক দিতে। মা ছাড়া সেই কষ্ট, সেই অপমানের গ্লানি আর কারো বোঝা সম্ভব না। বাচ্চা একসময় বিপদমুক্ত হলো। হাসপাতালের তরফ থেকে একজন নার্সকে আনা হলো শুধু আমার জন্য, যেহেতু বাচ্চা দুধ খেতে পারছে না। সেই নার্স আমাকে চেক করে কিছু ট্রিটমেন্ট করে দিল, আর কিছু টিপস দিল।
আমার খালা দয়াপরবশ হয়ে আমাকে তার বাড়িতে জায়গা দিলেন। আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে একটা ঘরে উঠলাম। বিনা অভিজ্ঞতায় একটা শিশুকে নিয়ে শুরু হলো অন্য জীবন। আমার খালা আমার মাকে জানায় আমার বাচ্চার কথা। মিথ্যে করে বলে আমার রক্তের দরকার। একথা শুনে আমার মা-বাবা হাসপাতালে আসতে চান, কিন্তু আমি তো তখন আর হাসপাতালে নেই। তাই তাদের আসাটা নিবৃত করা হয় কোনমতে। আমার খালা তাও চেষ্টা করেন। আমার মাকে বাচ্চার কান্না শোনান। আমার মা শুনে ফোন কেটে দেন। যে কটা দিন ছিলাম আমার খালা চেষ্টা করেছিলেন তাদের মায়া জাগানোর। লাভ হয়নি।
যাই হোক, বাচ্চা এক ঘণ্টা পর পর জেগে উঠে খাবার চায়, আর আমি সিরিঞ্জ দিয়ে দুধ বের করে ফিডারে জমাই। খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ঘুমানোর সুযোগ নেই। আত্মীয় স্বজনেরা সাহায্য যতটুকুই করেন সেটুকুতেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ। সেখানে এটা দরকার ওটা দরকার বা অধিকার ফলানো শোভনীয় নয়। আমি নিজেকে অনাহুতই ভাবি, তাই খুব সাবধানে পা ফেলি।
এক রাতে আমার মেয়ে হয়তো বেঁচে থাকার আদিমতায় কামড়ে আমার ডান দিকের নিপল বের করে আনে। অনেক ব্যাথা পাই, কিন্তু ও খেতে পারছে দেখে আনন্দিত হয়ে যাই। কিন্তু ভোগান্তি তখনও বাকী ছিল। ১১দিন বয়সে আবার জন্ডিসে আক্রান্ত হয় মেয়ে। পাগলের মতো ছুটি হাসপাতালে। এক দূর সম্পর্কের খালাকে সাথে যেতে অনুরোধ করলে তিনি যান, কিন্তু পরদিনই কিছু অজুহাত দেখিয়ে হাসপাতালে থেকে কেটে পড়েন।
আমি হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে থাকি। দিন নেই, রাত নেই যখনই আইসিইউ থেকে ডাকে, আমি মেয়েকে দুধ খাওয়াতে ছুটে যাই। আমি গোসল করি না, ঘুমাই না, সেই ওয়েটিং রুমে আধ শোয়া হয়ে থাকি। আমার মেয়ের বিলুরুবিন কমে না। বরং বেড়েই চলে। আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। কেউ পাশে এসে বলে না পাশে আছি, ভয় পেও না। আমি আর আমার স্বামী আর কিছু ধার করা মানুষ যাদের সাথে আমার রক্ত সম্পর্ক নেই। আমার বাবা-মাকে নাকি জানানো হয়েছিল, তারা কোন রেসপন্স করেননি।
একসময় ঝড় থামে। আমরা মা-মেয়ে যুদ্ধক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যাই। অল্প কয়েকটা বছরে আমার অভিজ্ঞতা খুব বেশি বেড়ে গেল। সম্পর্কের রূপ দেখলাম, সুসময় আর দুঃসময়ে, হয়তো আরও অনেক দেখার বাকি…।
(চলবে…)