লুকানো ডায়েরি থেকে -৯

চেনা অপরিচিতা: বিয়ের পর যা খচ খচ করছিলো, তা হলো বাসায় জানানো। কিন্তু কীভাবে জানাবো? বিয়ের রাতে খেতে খেতে ভাইকে বললাম। ভাইয়া বললো, “আমি পারবো না”। আর আমার পক্ষে তো সম্ভবই হবে না আম্মাকে মোকাবেলা করা 

তখন শেষ উপায়, বন্ধুটিকে দিয়ে বলানো, যে বিয়েতে আমার একমাত্র লোক। বন্ধুটি খুবই সরল প্রকৃতির। পরদিন সকালে তাকে দিয়ে বলালাম। তাকে বুঝিয়েছিলাম যেভাবে, সে সেভাবে বলতে পারেনি। ভাইয়া যে আমার বিয়ে দিয়েছে এই ব্যাপারটি তাকে আড়াল করতে বলা হলেও তাই সে ফলাও করে আমার মায়ের কাছে ফোনে জানালো।

রাতে ভাইয়া আমাদের বিয়ে শেষে ওর বন্ধুর সাথে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি ও আমাদের বাসায় গিয়েছে ঘুমাতে। বন্ধুটি জানানোর একটু পরই ভাইয়ার ফোন। তীব্র ধমক, কেন বাবা-মাকে তার সাথে আলাপ না করে জানালাম। খুব একটা সদুত্তর দিতে পারলাম না ঘটনার আকস্মিকতায়। ভাইয়া নতুন বর নিয়ে বের হয়ে যেতে বললো ওর বাসা ছেড়ে। আমি আজ এমনিতেই যেতাম। এক পশলা অপমান শুধু ছুঁয়ে গেল।

আমার বর অবশ্য কিছুই মনে করেনি। সে তখন তার সদ্যলব্ধ ভালবাসা যে তার হাতে তুলে দিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অন্ধ। সে সময় তাকে চড় মারলেও সে হাসিমুখে থাকতো বলে জানালো সে। কিন্তু বুকের খুব গভীরে, একটা আলপিন, একটা লজ্জার, একটা অপমানের চোরকাঁটা নিয়ে আবার ঘর ছাড়লাম। তবে এ ঘর ছাড়া স্বস্তির, অপমানের জ্বালা ভুলে, নতুন একটা পরিচয়ের সন্ধানে, নতুন কোন অধিকার নিয়ে বাঁচার জন্য ঘর ছাড়া।

বিয়ের পর আমার স্বামীর ছোট্ট এক রুমের বাসায় ১০/১২ দিন চাপাচাপি করে ছিলাম। নতুন বাসায় উঠলাম পরের মাসে। দুই বেডরুমের নতুন ফ্ল্যাট। কী যে শান্তি! নিজের সংসার। ফার্নিচার বলতে একটা খাট আর একটা চেস্ট ওফ ড্রয়ার আর ফ্রিজ। খুব কম দামে কেনা আকাশী রঙের পর্দা জানালায় ঝুলতে দেখে কী যে ভালো লাগতো। ছুটা বুয়া জোগাড় করে এনে তাকে আমাকে দেখিয়ে যখন আমার বর বলে, “এই যে, ইনি বেগম সাহেব”; যখন অফিস যাওয়ার আগে নিয়ম করে গালে চুমু দেই আমরা, যখন আমার ঘুম ভাঙে সনু নিগমের “ বাওরি পিয়া কি…” গানে, আর চোখ মেলে দেখি আমার ভালবাসার মানুষ আমার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে, যখন ফ্রিজের একদিনের বাসি খাবারও আমাকে খেতে দেয় না, তখন মনে হয় আমি ভুল করিনি।    

মতানৈক্য যে ঘটতো না, তা নয়। কিন্তু ঝগড়া হতো না। সে গায়ে শার্ট চড়িয়ে বাইরে চলে যেত। কিছুক্ষণ পর এসে আবার আগের মতো। এই সময়ে ভাই কোন খোঁজ নেয়নি। কিন্তু বিয়ের ৩/৪ মাস পর একদিন ভাইয়া বাসায় এলো। আমাদের ডাইনিং টেবিল ছিল না। নিচে একটা ভাঙা টেবিল পড়ে ছিল, সেটার উপর কভার দিয়ে নানা রকম খাবার সাজিয়েছিলাম। ভাইয়া খেয়েছিল তৃপ্তি করে। অনেকদিন পর নিজের কাউকে দেখে বড় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।

বিয়ের পর একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম। বিবাহিত মেয়েদের “অসুস্থ” কথাটি উচ্চারণ মানুষ সহজভাবে নেয় না। কোন না কোনভাবে সেটি সন্তান প্রজননের পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা এদেশের মানুষের, বিশেষ করে নারী সমাজের কমন প্রবণতা। শুধু তাই নয়, সন্তান নিতে দেরি কেন, বা দেরি ঠিক নয়, এধরনের আলোচনা, বা পরামর্শ চাপা গলায় দেওয়াতে হয়তো গোপন কোন আনন্দ লাভ হয় ওনাদের। আমার জানতে মন চায়, যখন এ ধরনের আলোচনা করেন, তখন কি তাদের মানসপটে কামোদ্দীপক নরনারী ভেসে ওঠে?

একা থাকা আমার জন্য খুব বড় ব্যাপার নয়। বরং একা থাকতেই ভীষণ ভালো লাগতো। বুয়া এলেও বিরক্তি লাগতো। কিন্তু মাঝে মাঝে বড্ড বোরিং লাগলে লেখালেখি করতাম। ঘর সংসারের কাজ আগে তেমন করিনি। অনেক ভুল হতো, ঐ ভুলগুলো থেকে শিখতাম।

সন্ধ্যার পর যখন বর বাসায় ফিরতো, তখন দুজন মিলে গলা-পোড়া খিচুড়ি, বা যা রান্না হতো, তাই খেতাম।

আমার আনা কাপড়গুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার স্বামীর গেঞ্জি আর পেটিকোট পরে থাকতাম। নিজের জন্য আগ বাড়িয়ে কিছু কিনতে ইচ্ছা হতো না। আমি অপেক্ষা করতাম কবে সব মেঘ কাটবে।

কারও সাথে সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও অনেক খবর পেতাম। আমার বিয়ের খবর কাউকে প্রকাশ করছে না আমার বাবা-মা। বাসায় এখনও ঘটক আসছে। হুজুরের তদবির চলছে আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। হুজুর আশা দিয়েছে, আমি ফিরে আসবো। আমি আমার খালার বাসা থেকে চলে এসেছিলাম, তাই ব্যাপারটায় আমার খালাকে দোষী ভাবা হচ্ছে। আমার মা খালার অমঙ্গল চেয়ে রোজ একটা মাটির চুলায় দোয়া লেখা কাগজ পুড়ছে। আমি ফিরলে আমার আবার বিয়ে দেবে। আমার বাবা বলেছে, আমি শারীরিক প্রয়োজনে এই বিয়ে করেছি, প্রয়োজন মিটলে আবার ফিরবো তাদের কাছে। আমার স্বামীর তিনটি বিয়ে, সন্তানও রয়েছে। আমার শাশুড়ি ফকিরনী। আমার স্বামী আমাকে যাদু করেছে। আমাকে আমার স্বামী অত্যাচার করে, ড্রাগ পুশ করে…ইত্যাদি কথা আমার কানে আসতো।

আমি খালি বাসায় মাঝে মাঝে অসহ্য অপমানে নীরবে চোখের জল ফেলতাম, কখনো মায়ের কথা মনে করে বুক চাপড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতাম। বিধাতার প্রতি বড্ড বেশি বিশ্বাস ছিল। পাঁচ বেলার নামাজে কেঁদে কেঁদে মাকে চাইতাম। মা, যার রক্ত থেকে আমার অস্তিত্ব; মা, যাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালবাসতাম; মা, যার কাছে আমার ছয়টি সন্তান বাস করতো, ওরা কেমন আছে, ওরা ওদের মাকে ছাড়া নিশ্চয়ই খুব অযত্নে আছে… ভাবলেই পাগল হয়ে যেতাম।

কিন্তু আমি জানতাম না, অথবা ভাবতে পারতাম না আমার বর্তমান পরিচয়কে আমার মা কতোটা ঘৃণা করে!

আমি বাড়ি গিয়েছিলাম। একবার নয়, বেশ অনেকবার। সে কথা না হয় পরের বার বলি। আজ আর ভালো লাগছে না!

(চলবে…)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.