লাভলী ইয়াসমিন: বাংলার নারীরা শুধু ভাবতে জানে না, বলতেও জানে, লিখতেও জানে। উইমেন চ্যাপ্টার তার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।
প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে মেয়েদের সাথে ঘটে চলেছে অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। আর সেসব ঘটনার নীরব সাক্ষী শুধুমাত্র ভুক্তভোগী মেয়েরা। আফরোজা সোমা’দের মতো হাতে গোনা নগণ্যসংখ্যক মেয়ে আছে, যারা “লজ্জা নারীর ভূষণ” নামক এই তথাকথিত ডায়লগকে জয় করতে পেরেছে। আর পেরেছে বলেই জিপার খোলা জানোয়ারদের আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

এমন ঘটনা প্রতিদিন হরহামেশা কারও না কারও সাথে ঘটছে, কিন্তু কজন মুখ খুলছে, বলুন তো?
আমার এখনো একটা ঘটনা মনে পড়লে গা ঘিনঘিন করে, ২০০৫ সালের কোনো একদিন আমি আর আমার বান্ধবী মুক্তা রোকেয়া হল থেকে সায়েন্স এ্যানেক্স ভবন যাচ্ছিলাম ক্লাশ করতে। হঠাৎ শিববাড়ির মোড়ের ওখানে রিকশা করে মধ্যবয়সী এক লোক যাচ্ছিল, আমাদের দেখা মাত্র লোকটা ঝড়ের গতিতে তার লুঙ্গি উঁচু করে অত্যন্ত গর্বের সাথে নিম্নাঙ্গ দেখিয়ে চলে গেল। আমরা থ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম এমন নোংরামি দেখে।
এটা কি একটা মেয়ের জন্য মানসিক হয়রানি নয়? আচ্ছা বাদ দিলাম এগুলো না হয় মানসিক হয়রানি, শারীরিক হয়রানির কথা বলতে গেলে তো সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করতে হয়। আমার বয়স যখন চার তখন নানা সম্পর্কিত এক আত্মীয় আমাকে কারণে-অকারণে কোলে নিত এবং তার নিম্নাঙ্গ আমার গায়ের সাথে ঘষতো। তখন এর মানে না বুঝলেও পরে যখন বুঝেছি তখন মায়ের সাথে শেয়ার করে হালকা হয়েছি।
বড় হওয়ার সাথে সাথে এ ধরনের আরো অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে যা মনে হলে এখনো গায়ের মধ্যে জ্বালা ধরে। আমাদের এই বিপদ সঙ্কুল সমাজে টিকে থাকার জন্য প্রতিকূল পরিবেশই হয়তো আমাদের সাহসী করে তুলছে। তাই আমরা আজ প্রতিবাদের আওয়াজ তুলছি যেখানে যেমন প্রয়োজন।
প্রতিবাদের পরিসরটা ক্ষুদ্রতা ছেড়ে একদিন গণজোয়ারে পরিণত হবে, সেদিনটা দূরে নয়। মনে আছে একবার মিরপুর থেকে বাসে করে নীলক্ষেত আসার সময়ের একটা ঘটনা। অল্প বয়সী একটা মেয়ে বাস থেকে নামছিল ধানমন্ডির কোনো একটা জায়গায়, হেলপারটা ইচ্ছা করে মেয়েটার বুকে হাত দিল। চলন্ত গাড়ি বিধায় মেয়েটার করুণ মুখটা দেখার দুর্ভাগ্য হলো না, কিন্তু আমি যেটা করেছিলাম- সজোরে চিৎকার করে বলেছিলাম, “এই তুই ঐ মেয়েটার গায়ে হাত দিলি কেন, কাটা চামচ দিয়ে তোর চোখ তুলে নেব”। গড়গড় করে কিভাবে যে প্রতিবাদ করেছিলাম আমি, আজও ভাবলে ভাল লাগে। একজন মধ্যবয়সী লোক আচ্ছামতো মারল ছেলেটাকে, হয়তো তার নিজের মেয়ের চেহারাটা ভাসছিল তার সামনে। তারপর আমার জীবনে এ রকম ঘটনা যতবার ঘটেছে, খুব সুচারুভাবে সেগুলো সামাল দিয়েছি। তাই নারীকূলের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, একবার সোচ্চার হোন, দেখবেন আপনার সাহসিকতা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
প্রতিটা মেয়েকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে তার জীবনে পুরুষের দ্বারা কোন হয়রানির ঘটনা আছে কিনা, আমি হলফ করে বলতে পারি তারা এক বাক্যে অকপটে স্বীকার করবে, ‘হ্যাঁ’ আছে। এখন কথা হচ্ছে, এই একই প্রশ্ন যদি ছেলেদের করা হয়, ওরা কি বলতে পারবে ওরা কোনো মেয়ের দ্বারা হ্যারাজড হয়েছে?
যারা উইমেন চ্যাপ্টারের সমালোচক, তাদের কাছে ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা, “আপনারা কি কখনও আপনার মেয়েকে, বউকে, বান্ধবীকে বা বোনকে প্রশ্ন করে দেখেছেন, তাদের জীবনের অতলে তলিয়ে থাকা এমন কোনো ঘটনা আছে কিনা, যা মনে করলে তারা এখনও বেদনায় নীল হয়ে যায়”!
আবার যদি নিজের ফ্যামিলির দিকে তাকান, সেখানেও দেখতে পাবেন আপনাদের ইচ্ছেগুলোকে ভালোলাগাগুলোকে কোনো না কোনো ভাবে মেয়েদের ইচ্ছা, ভালোলাগাগুলোর উপর বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। মেয়েরা যদি চুপচাপ এগুলো মেনে নেয়, তবে তারা খুব ভালো, আর হিতে-বিপরীত হলেই উচ্ছৃঙ্খল। অমনি নারীবাদ নিয়ে আপনারা ভাবতে বসে গেলেন।
উইমেন চ্যাপ্টারকে, তদুপরি সুপ্রীতিদিকে লাল সেলাম এমন একটা দ্বার উন্মোচনের জন্য, যেখানে নারীরা বাধাহীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “পড়লো কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে”। উইমেন চ্যাপ্টারের অখ্যাত লেখিকাদের লেখা যদি আমাদের ভদ্র সমাজের স্যুট-কোট-টাই পরা লোকদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, তাহলে এর দায় তো উইমেন চ্যাপ্টারের উপর বর্তাবে, এটাই স্বাভাবিক।
তাই বলে কী থেমে থাকবে এইসব লেখিকার লেখনী? মোটেও না। বরং নতুন উদ্যমে লেখার অনুপ্রেরণা পাবে তারা। উইমেন চ্যাপ্টার যদি অনলাইন পোর্টাল না হয়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বসবাস করা নারীদের কাছে পৌঁছে যেতে পারতো, তাহলে হয়তো অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারীই তাদের মনের না বলা কথাগুলো বলার সাহস পেতো। আসছে বছরের জন্য আগাম অনেক অনেক শুভকামনা থাকবে উইমেন চ্যাপ্টারের জন্য।