ভিকারুন নিসা: তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর। গন গনে রোদে সবকিছুই ঝলসে যাচ্ছে। গাড়িটা ব্রিজের গোড়ায় থামিয়ে ড্রাইভার বললো, আপা আসতেছি। গাড়ি থেকে নেমে সে চলে গেল ঝুপরীর মতো ছোট্ট দোকান ঘরটার দিকে। আমার সেই তখন থেকেই কেমন অস্থির লাগছিলো। গাড়িটা বন্ধ হওয়াতে এসিটাও বন্ধ। এসি বন্ধ হতেই অস্থিরতা যেন বাড়লো আরেকটু। হাত বাড়িয়ে জানালাটা খুলে একটু ভালো করে নিশ্বাস নিতে চাইলাম।

জানালা খুলে তাকাতেই মুগ্ধ চোখ আটকে গেল টলটলে বিলের জলে। ভরা বর্ষায় বিলের টই টম্বুর জলে লাল, গোলাপী, বেগুনি শাপলারা রং এর পসরা সাজিয়েছে দিগন্ত জুড়ে। ছোট্ট নৌকার গলুয়ে বসে উদাস চোখে বৈঠা টানছে যে কিশোর তার কন্ঠেও মাতাল করা সুর। আকাশের গনগনে রোদ বিলের টলটলে জল ছুঁয়ে যেন সোনালী দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তবুও কোন কিছুতেই মন বসছে না, দম বন্ধ লাগছে আমার। অসম্ভব যন্ত্রণায় দদ্ধ হতে হতে ফিরে যাচ্ছি ঢাকা। নমিতার অসহায় দু’চোখের বিষন্ন দৃষ্টি, নীল কষ্টের মুখটি আমাকে যে অপরাধী বানিয়েছে সেই সকাল থেকে, তা থেকে নিজেকে বের করতে পারছি না কিছুতেই।
নমিতা আমার খেলার সাথী, কৈশোরের সহচরী। আমাদের শৈশবের সময়টা ঘিরে কত গল্প, দু:খ, আনন্দ একসাথে জড়িয়ে আছে। আমি বড় হয়েছি যে গ্রামে সেখানে কয়েকটা পাড়া ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হিন্দু পাড়া। সেখানে সবচেয়ে সুন্দর করে লেপা-পোছা যে বাড়িটা, ওটাই ঠাকুর বাড়ি। চারিদিকে নারিকেল আর আম-কাঁঠালের সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা। পাখিদের কলতানে, বাতাসে ধুপের গন্ধে মাতাল করা সেই বাড়িতেই আমার বন্ধুর বসবাস।
নমিতাদের উঠোনে কাঠের পিঁড়িতে বসে তাল পাতার পাখায় বাতাস খেতে খেতে দুজন গলা মেলাতাম –আয় তবে সহচরী, হাতে হাত ধরি ধরি। ছোট বেলাটায় দুজনে হাতে হাত ধরেই থাকতাম। মেসো মশাই বলতাম ওর বাবাকে। কাপড়ের দোকান ছিল ওনার। পূজোয় নমিতার জন্য ফুল ছাপা কামিজ বানালে আমার জন্যও উপহার হিসেবে একই রকম কামিজ বানিয়ে দিতেন। একমাত্র কন্যার বন্ধু বলে কথা।
ওদের বাড়ির নারিকেলের নাড়ু আর খেজুর গুড়ের সন্দেশকে আমার পৃথিবীর সেরা খাবার মনে হতো। ধর্ম কখনো আমাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কলেজে পড়ার সময় ওর বিয়ে হয়ে গেল। তারপরও বন্ধুত্বের বাঁধন ছিন্ন হয়নি। এক সময় অবশ্য যোগাযোগ কমে গেল। কিন্তু ওকে ভুলে যাইনি কখনো। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। ওর স্বামী স্কুল শিক্ষক, ওর দুটি মেয়ে নিয়ে বেশ সুখী জীবন তার।
কাল সকালে ঘুম থেকে উঠতেই ওর ফোন পেয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ- তুই একটু আসতে পারবি রে? ভীষণ ভয়ার্ত, ভঙ্গুর সে কন্ঠ।
আমি উদ্বিগ্নতা নিয়ে প্রশ্ন করলাম-কেন কী হয়েছে? সুভাষদার সাথে ঝগড়া হইছে?
আমার উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে ও বললো, তোর সাথে শেষ দেখা করতে চাই, কাল ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি। খুব ইচ্ছে করছে রে তোরে দেখতে। সব কথা ফোনে বলতে পারবো না, তুই আয়। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ওর কন্ঠে।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। কী এমন হলো, নমিতাও ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। ভালোই তো ছিল দুই কন্যা আর স্বামীকে নিয়ে। মধ্যবিত্ত জীবন সুখেই তো কাটছিলো।
একটু ইত:স্তত করে বললাম, ঠিক আছে আসবো কাল।
সকালে বেরুনোর আগে এক কাপ চায়ের সাথে দুটো টোস্ট বিস্কুট তুলে নিলাম বৈয়াম থেকে। ধোঁয়া উঠা গরম চায়ে চুমুক দেয়ার পরও কেমন ঝিমুনি লাগছিলো। তারপরও কাক ডাকা ভোড়েই রওনা হলাম পূবাইলের কয়ের গ্রামে। গাড়ি ছুটে চলেছে, চোখ বন্ধ করে কত কী যে মনে পড়ছে।
ওর স্বামী সুভাষদার লাজুক হাসি, মিষ্টি দুই মেয়ের কথার ফুলঝুরি, নমিতার শান্ত মুখ কত কী! ওখানেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সুভাষদা। কত বছর ধরে পড়াচ্ছেন সে স্কুলে তা নমিতাও ভালো করে বলতে পারে না। দু’বার গেছি ওদের বাড়ি। প্রথমবার ওর বড় মেয়ের জন্মের পর, দ্বিতীয়বার আমার বিয়ের পর আমার স্বামী শাহেদকে নিয়ে। আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিল ওরা।
দোচালা বিশাল টিনের ঘর, বাঁধানো তুলসী তলা, এ বাড়িতেও প্রচুর ফলের গাছ। এক কোনায় তুলসী গাছের নিচে ঠাকুর, মাটির রান্না ঘরে ধোঁয়া তোলা গরম ভাতের গন্ধ। জবা ফুলের টকটকে রং,সবকিছুই মিলিয়ে সুখী, সচ্ছল পরিবার। কত রকম খাবার যে রান্না করেছিল নমিতা। কোনটা রেখে কোনটা খাবো। শাহেদ তো মহা খুশী এমন আপ্যায়নে। সেদিন মন ভরে আড্ডা দিয়েছিলাম দু-বন্ধু। গল্প, হাসাহাসি, দুষ্টুমি, ইস্ কী মধুর সে সময়! ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো আমার।

-আপা, আপা। উঠেন, আপা চলে এসেছি। ড্রাইভার কখন থেকেই ডেকে চলেছে। আমার ঘোর কাটলো যেন। চোখ মেলে তাকালাম। হ্যাঁ, তাইতো। এটাই তো নমিতাদের বাড়ি। এই যে বাড়িতে ঢোকার পথে যে সবুজ নারকেল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। সেবার নারিকেলে ভরে ছিল। আমাকে জোর করে ডাব পেড়ে সাথে দিয়ে দিয়েছিল সুভাষদা।
আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। পা বাড়িয়ে নারিকেল গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। গাছের ডালে একটা কাক কী বিচ্ছিরি সুরে ডেকে চলেছে। পুরো বাড়িটাই নিঝুম পুরী যেন। সবাই কি ঘুমিয়ে আছে এখনো? বুঝতে পারছিলাম না। উঠোন পেরিয়ে ওদের শোবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম।
আস্তে করে দরজায় টোকা দিলাম – এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিস নাকি!
ওপাশ থেকে ফিস ফিস শব্দ। আস্তে কাঠের দরজাটা একটু ফাঁক হলো, দুটো বড় বড় চোখ দেখা গেল। তারপর পরমুহূর্তেই একজন দরজা খুলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে ভীষণ শক্ত করে। আমার শরীরে লেপ্টে ও থর থর করে কাঁপছিলো। কান্নার শব্দে কন্ঠ ভারী ঠেকছিলো। গায়ে তরকারির উৎকট গন্ধ। তারপরও প্রবল আবেগে সে গন্ধময় শরীর জড়িয়ে ধরলাম দু’হাতে।
-নমিতা শোন, কী হইছে? খুলে বল। নমিতার ফুঁপিয়ে কান্না বন্ধ হচ্ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে থাকলো ও। মনে মনে ভাবলাম, আহা কাঁদুক না। কেঁদে যদি একটু হালকা হয় সে।
সুভাষদা আস্তে আস্তে সব খুলে বললেন। ওদের বাড়িটা এমপি সাহেবের ভাতিজার পছন্দ অনেকদিন থেকেই। ওদের পাশের ঘর, প্রতিবেশী নিশীথ দত্ত যেদিন বাড়িঘর বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেল সেদিনই আসলে ওদের কপাল পুড়লো। তারপর থেকেই এ বাড়ির প্রতি শকুন দৃষ্টি এমপির ভাতিজা ঝন্টুর। সুভাষদার মতো নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বেশ কটি। প্রতি মাসেই এখন থানা, আদালত, উকিল এর কাছে দৌড়াদৌড়ি।
তার ওপর মরার উপর খাড়ার ঘা। এখন শ্যেন দৃষ্টি তার মেয়ের দিকে। মেয়েকে আজে বাজে চিঠি পাঠাচ্ছে, মোবাইলে হুমকি। রাতে বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ছে। মাসখানেক ধরে ওর কন্যা আরতির স্কুল বন্ধ। এরপর আর কী করা যায়! অবশেষে ভিটে-বাড়ি ওদেরকেই নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দিতে হলো। এমপির ভাতিজাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে বর্ডার পার হবার। আজ রাতের আঁধারে দুই কন্যা নিয়ে ওরা ওপারে চলে যাচ্ছে।
দুজনেই বসে আছি উঠোনে। মাথার উপর সূর্যটা ভীষণ তপ্ত। রোদে সবকিছু ঝলসে যাচ্ছিল। উঠোন, ঘরের টিনের চালা, এমনকি উঠোনে দড়িতে টানানো শুকনো কাপড় যেন কট কট করছিলো। রোদে তপ্ত নমিতার চেহারাও ঘামে ভেজা আর ভীষণ বিষন্ন। যেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ওর পেছনে আজরাইল দাঁড়িয়ে। সে মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এ কদিনে কি নমিতা ভীষণ বৃদ্ধ হয়ে গেছে? সামনের দিকে মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে অনেকখানিই।
আমি সে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম-ওখানে গিয়ে কী করবি? চলবি কেমন করে?
ফ্যাস ফ্যাসে গলায় নমিতা বললো, ওখানে তোর সুভাষদা একটা মুদি দোকান কিনেছে। আমার জ্যাঠার ছেলে, সেই কিনে দিয়েছে। স্কুলের শিক্ষক দোকানদারি করবে? কী বলিস? পারবে সে? আমি আঁতকে উঠলাম।
নমিতা কোনো জবাব দিল না। বিশাল দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে ছিটকে পড়লো ওদের কুয়ো তলারও ওপাড়ে। কান্নায় ভারী চোখের পাতা আটকে থাকলো তুলসী তলায়। অসহায় চোখ দুটোতে শুধু অব্যক্ত বেদনা।
সেই কোন যুগে ওদের পূর্বপুরুষেরা এ গ্রামে বসত গেড়েছিল কে জানে। শিকড় গেঁথে আছে মাটির অনেক গভীরে। সেখান থেকে তুলে এনে অনিশ্চয়তার মাঝে এ মধ্য বয়সে নুতন দেশে জীবন শুরু। ভীষণ কঠিন এ যাত্রা। আমি জানি না এ যাত্রার শেষ কোথায়।
আমি বিষন্ন গলায় বললাম, নমিতা যাস না। যে দেশে কখনও যাসনি, যেখানে কিছুই চিনিস না, ওখানে গিয়ে কীভাবে থাকবি?
কে যেতে চায় পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে? আমাদের যেতে বাধ্য করা হয়। বুঝলি? ঘৃণায় ভরা সে কন্ঠ। নমিতা কেমন জানি হাসলো, ভীষণ অচেনা সে হাসি।
-আমার মেয়ে দুটোতে ভাল থাকবো। অন্তত: আমারে জাত খোয়াতে হইবো না। এরপর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো, চোখের কোল ভরে গেল নোনা জলে।
-তুই আমার সমস্যাটা বুঝবি না,তোরা কেউ বুঝবি না। কেমন জানি শ্লেষ ওর কন্ঠে।
আমি পাত্তা দিলাম না সে সব-মাসি, মেসো মশাইয়ের কথা ভাব।
-সবার আগে আমার দুই মেয়ে। আমার চোখে ওর চোখ। তির্যক সে চোখে কি একটু ঘৃণাও নেই?
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। সত্যি বলতে কী, কথা বাড়িয়ে কী লাভ! আমার তো কিছুই করার নেই। আমি কলেজে পড়াই, আমার স্বামী একটা এনজিও’র কর্মকর্তা। ক্ষমতা-প্রতিপত্তি কিছুই নেই আমার। আমরা তেমন প্রভাবশালী কেউ নই। কিছু করতে চাইলে হয়তো দেখা যাবে আমরাও অনেক বিপদে পড়বো।
চুপচাপ বসে রইলাম মাটির লম্বা বারান্দাটায়। ওপাশে কালো একটা বিড়াল ভীষণ তির্যক চাহনীতে আমায় দেখছে। হঠাৎ গা কেমন শির শির করে উঠলো ভয়ে। আশে-পাশে কেউ কি আমাকে অনুসরণ করছে? কী জানি! ওসব লোকজন তো সম্পত্তির লোভে অনেক কিছুই করতে পারে। আমি গা শির শিরে ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুপুর মাথায় নিয়ে একসময় ফিরে চললাম। পেছনে পড়ে রইলো আমার অনেকদিনের পুরনো শৈশব আর তার তীব্র দীর্ঘশ্বাস।