বিধি-নিষেধ বিধবার জন্য, বিপত্নিকের জন্য নয়

লাবণ্য লিপি: একটি মেয়ের ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠান হচ্ছে। উভয় পক্ষের আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব স্টেজে গিয়ে মেয়েটির গায়ে হলুদ মাখিয়ে চলে আসছে। কিন্তু তার নিকট আত্মীয় কম বয়সী বিধবা নারীটিকে জানিয়ে দেওয়া হলো, তুমি হলুদ মাখিয়ে দিও না। চাইলে মিষ্টি খাইয়ে দিতে পারো! যেটুকু বলতে পারলো না তা হলো, তুমি কাছে না গেলেই ভালো হয়।

মেয়েটি মনে মনে আহত হয়। অতি প্রিয় আদরের ভাগ্নিটিকে তার আর মিষ্টিও খাওয়াতে ইচ্ছে করে না। গোসলের সময়ও তাই। ঘোষণা দেওয়া হলো, পাঁচজন এয়োস্ত্রী মেয়েকে গোসল দিতে আসেন। অনাত্মীরা যাওয়ার অনুমতি পেল। অথচ অতি আপনজন হয়েও বিধবা হওয়ার অপরাধে সে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে পারলো না।

অথচ ছোটবেলায় এই ভাগ্নিকেই সে কত যত্নে গোসল করিয়েছে, গায়ে লোশন মেখেছে, মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিধবা হওয়া কি অপরাধ? মেয়েটি কি তার স্বামীর হত্যাকারী? তাহলে কিসের অপরাধ? যে অপরাধ সে করেনি, তার শাস্তি কেন তাকে সব সময় পেতে হয়? শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে কেন, যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে বিধবা মেয়েটি বা নারী অনাহুত।

কিন্তু একইভাবে দেখা হয় কি বিপত্নিককে? কখনো কি শুনেছেন যে, যিনি বিপত্নিক, তিনি এটা করবেন না, ওটা করবেন না!

লাবণ্য লিপি

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। যদি কোনো মেয়ের স্বামী মারা যায়, তখন আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে, আজকালকার মেয়েরা কোনো নিয়ম-কানুন মানে না। বিয়ের পরও হাতে চুড়ি পরে না, নাকফুল পরে না। তাই তো টপটপ করে অল্প বয়সেই স্বামী মরে যায়। আরে যুগ যুগ ধরে মুরুব্বিরা যেসব নিয়ম- কানুন মেনে এসেছে, সে কী এমনি এমনিই!

কিন্তু যদি কারো বউ মারা যায়? অকালে? স্বামীটির ওপর কি কোনো দায় গিয়ে পড়ে? তবে কি সামাজিক এসব সংস্কার শুধুই মেয়েদের জন্য? আর সনাতন ধর্মের হলে তো স্বামীর মঙ্গল কামনায় নারীকে শাঁখা-সিঁদুর পরতে বাধ্য করা হয়। অথচ স্বামী চিরকালই সামাজিক বিধি নিষেধের ঊর্ধ্বে। স্ত্রী’র মঙ্গল কামনায় তাকে কখনো অলংকার পরতে হয় না, টিপ দিতে হয় না, সিঁদুর পরতে হয় না।

আবার যদি কোনো বিধবা সাজ-গোজ করে, তাতেও কিন্তু চোখ টাটায় সমাজের। ধরুন বিধবা মেয়েটি চাকরিজীবী। অন্য দশজন মানুষের মতোই সে সাজ- পোশাক পরে তৈরি হয়ে অফিসে যাচ্ছে। তাকে যেতে দেখে প্রথম বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় প্রতিবেশি। পাশ কাটিয়ে যেতেই শুরু হয় ফিসফিসানি, দেখলেন ভাবী, বিধবা অথচ কী সাজ- পোশাক! শাড়ি পরছে আঁচল ভাঁজ করে। পেট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।

সালোয়ার- কামিজ, প্যান্ট- শার্ট বা ফতুয়া পরলেও দোষ। দ্যাখেন, ওড়না গলায় বা সাইডে পরেছে। হুহ! বিধবা আবার প্যান্ট পরে! সেই জন্যেই তো কপাল পুড়ছে! অফিসের সহকর্মীরাও কিন্তু ছাড় দেয় না। সাদা-মাটা হয়ে অফিসে গেলে বলবে, ইস! কাজের বুয়ার মতো অফিসে আসে। আরে বাবা অফিসের তো একটা সাজ- পোশাক আছে! মনের কষ্ট কি দেখিয়ে বেড়াতে হবে! সেজে গেলেও আড় চোখে দ্যাখে, সুযোগ পেলে মন্তব্য করে। মোট কথা, বিধবার সবটাতেই দোষ।

সে যদি কোনো পার্টিতে যায়, একা কোথাও বেড়াতে যায়, তাহলে তাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। অথচ কোনো বিপত্নিকের পোশাক নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করেছে বলে শুনিনি কোনো দিন। সে যেখানে খুশি যেতে পারে, একা অথবা সঙ্গী নিয়ে, যেমন ইচ্ছে পোশাক পরতে পারে, যা ইচ্ছে করতে পারে। সমাজ তাকে কটাক্ষ করে না। তাকে নিয়ে ফিসফিসানি, কানাঘুষা হয় না।

এবার আসুন বিধবার প্রতি সমাজের সহানুভূতির নমুনায়। মেয়েটি যদি অল্প বয়সে বিধবা হয়, তাহলে প্রথমে আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব বা পরিচিতজনরা খুব আহা- উঁহু করবে। হায়! মেয়েটির এখন কী হবে! কীভাবে চলবে? আহারে কত অল্প বয়স। জীবন তো কেবল শুরু করেছে। বাকী জীবন কীভাবে কাটাবে? কাজেই ওকে দেখে শুনে আবার বিয়ে দাও। ঠিক তখনই মেয়েটির আবার বিয়েতে মত আছে কিনা কিংবা মেয়েটি কী চায় সেটা ক’জনের কাছে জানতে চাওয়া হয়? আর মেয়েটি যদি স্বাবলম্বী, উপার্জনক্ষম হয়? তাহলেও সমস্যা। কী মেয়েরে বাবা! স্বামী মরে গেছে দেখে একটুও বোঝা যায় না। দিব্বি সেজেগুজে অফিস করে বেড়াচ্ছে।

বিপত্নিক লোকটা বুঝি বউয়ের শোকে মাসখানেক অফিস কামাই করে! কিংবা শোকে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ঘরে পরার পোশাকেই অফিসে চলে যান! তাই বলে বিধবার বিয়েটাও কিন্তু নির্ঝঝ্ঞাট নয়। বিয়ের অল্প কিছুদিন পর বিয়ে করলে, স্বামী মরার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে! শ্বশুর বাড়ির লোকেরা শুনিয়ে বলবে, কত মেয়েকে দেখেছি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়!

বিয়ে তো জীবনে একবারই হয়। প্রথমে যার সুখ হয় না, দ্বিতীয় বিয়েতে কি আর সুখ হয়! অথচ এদেরই বিপত্নিকের জন্য দরদ উথলে ওঠে। আহারে! পুরুষ মানুষ কি বউ ছাড়া থাকতে পারে! তার দেখাশোনা কে করবে, ঘর কে সামলাবে? যেন বউ ঘর সামলানোর জন্য, স্বামীকে চালানোর জন্যই।

বিধবা মেয়েটির জৈবিক চাহিদা পাপ। কিন্তু বিপত্নিকের জন্য স্বাভাবিক। বিধবার অবিবাহিত ছেলের সঙ্গে বিয়ের ঘটনা বিরল। অথচ বিপত্নিক নির্দ্বিধায় অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। আর বিধবা যদি হন সন্তানসহ? তাহলে তো দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তার চাহিদা নিচের দিকে নামতে থাকে। বউয়ের সঙ্গে ছেলে- মেয়ের দায়িত্বও নিতে হবে! বিপত্নিক স্বামীর ঘরে যদি সন্তান থাকে, তাহলে সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা ভীষণভাবে চাইবে মেয়েটি ঐ সন্তানদের মা হয়ে উঠুক। একটু এদিক-ওদিক হলেই অত্যাচারি সৎ মায়ের তকমাটা তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিপত্নিক লোকটা কিন্তু আগের সন্তানদের বাবা হয়ে উঠতে চান না কিছুতেই। তাতে সমাজের কেউ তার দিকে আঙুল তোলে না। তখন প্রবাদ আউড়ানো হয়, এক গাছের বাকল কি আরেক গাছে লাগে! এটা কি তবে মেয়েটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আন্দোলনের ফলে ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার তাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, যে লোকাচার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত, তা আসলে ধর্মবহির্ভূত স্থবিরতার আচারমাত্র।

হ্যাঁ, এটুকু সংস্কার হয়েছে বটে, বিধবা বিবাহ সমাজ মেনে নিয়েছে। কিন্তু বিধবা নির্যাতন কমেনি এতোটুকুও। কেবল তার ধরনটা বদলেছে মাত্র!

লেখক ও সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন: